গুগল ইফেক্ট বা ডিজিটাল অ্যামনেসিয়া কী, প্রতিরোধের উপায় কী?

ইউনিভার্সিটি অফ বার্মিংহামের এক গবেষণায় বলা হয়, অনেক মানুষ তথ্য আত্মস্থ করার পরিবর্তে তারা সেগুলো ইন্টারনেট বা সার্চ ইঞ্জিনে খোঁজে।
আর সার্চ ইঞ্জিনে খোঁজার এই প্রবণতাকেই বলা হয় গুগল ইফেক্ট। গুগল ইফেক্টের আরেকটি নাম ডিজিটাল অ্যামনেসিয়া।
ডিজিটাল অ্যামনেসিয়া হচ্ছে মস্কিস্কের দীর্ঘমেয়াদে তথ্য ধরে রাখার ব্যর্থতা। এই ইফেক্টের নানা ধরণের প্রভাব রয়েছে।
গুগল ইফেক্টের প্রভাব
অধ্যাপক মারিয়া উইম্বার বলেন, ইন্টারনেটে সার্চ ইঞ্জিন থেকে সহজেই এই তথ্য খুঁজে বের করার প্রবণতা “দীর্ঘ মেয়াদে স্মৃতিশক্তি গঠনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে”।
তার মতে কম্পিউটার ও সার্চ ইঞ্জিনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা মানুষের স্মৃতিশক্তিকে দূর্বল করে দেয়। কারণ যে তথ্য আমরা সার্চ কপ্রে বা খুঁজলেই পাই সেগুলো আমরা শিখি না।
ডা. উইম্বার বলেন, আমরা যতবার কোন তথ্য মনে করার চেষ্টা করি তত আমাদের স্মৃতিশক্তি সবল হয় এবং একই সাথে অপ্রয়োজনীয় তথ্য আমরা ভুলে যাই।”
এটা নেতিবাচক তো বটেই তবে অনেক সময় এটা বেশ সাহায্যকারীও। যেমন আপনি কোন একটি দোকানে কোন একদিন হয়ত রুটি কিনতে গিয়েছিলেন, কিন্তু যেখানে আপনি হয়ত আর কোনোদিনই যাবেন না ঐ দোকানের ঠিকানা মনে রাখার কিছু নেই।
পেন ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ন্যান্সি ডেনিস বলেন “কোন সন্দেহ নেই যে প্রযুক্তি আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে এবং এটি আমাদের মস্তিষ্কের কাজের ধরণও পাল্টে দিয়েছে।”
মিস ডেনিসসহ আরো অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন যে, শুধু নম্বর বা তারিখ মনে রাখার জন্যই মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখা ঠিক নয়। বরং এগুলো অন্য কেউ মনে রাখলে আমাদের মস্তিষ্ক আরো গঠনমূলক ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তায় ব্যবহৃত হতে পারে। তবে বিপত্তি বাধে যখন এটির কোনো স্বাস্থ্য কিংবা অতিব প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে ঘটে। যেমন আমরা জানি মানুষ যদি এমন অবস্থার মধ্যে পড়ে যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ নে সেখানে কাউকে কাটা-ছেঁড়া বা আগুনে পুড়ার ক্ষতের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার দরকার হলে আমাদের মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকলে সেটি আসলে কোনো কাজে আসবে না।
আমরা স্কুলে কেন পড়াশোনা করি? যাতে আমাদের মন এবং মস্তিষ্ককে আরো সুতিক্ষ্ণ, গোছানো এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা যায়।
গুগল ইফেক্টকে স্কুলে শিক্ষার বিপরীত বলে ধরা হয় কারণ এটি খুব দ্রুত যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় যা আমাদের বেশিরভাগ সময়ই মনে থাকেনা।
অন্যদিকে স্কুলের শিক্ষা হচ্ছে ধীরস্থির পদ্ধতিগত কিন্তু এটি আমাদের মনের উপর দীর্ঘমেয়াদি ছাপ তৈরি করে।
গুগল ইফেক্টের ফলে কী হয়?
গুগল ইফেক্টের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কতটা তা এখনও স্বীকৃত নয়। পেন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় বলা হয় যে ডিজিটাল এমনেশিয়া এখনও বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত না হলেও কগনেটিভ সায়েনটিস্ট অর্থাৎ যারা ভাষাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান, দর্শন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং নৃবিজ্ঞানের আলোকে মানুষের মন নিয়ে গবেষণা করেন এমন বিজ্ঞানীরা সহমত প্রকাশ করেন যে মনে রাখার জন্য মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীলতা কমলে তা মস্তিষ্কের নিউরনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে মস্তিষ্কের উন্নয়ন ব্যাহত হয়। গুগল ইফেক্টের এই প্রভাবের কথা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চর্চিত।
২০১১ সালের জুলাইতে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে চারটি গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষকে যখন কঠিন কোনো প্রশ্ন করা হয় তখন তারা প্রথমেই কম্পিউটার সম্পর্কে ভাবে এবং যখন তারা জানে যে এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই পাবে তখন তারা আর তথ্য মনে রাখার হার কমিয়ে দেয়। আর যে তথ্য আমরা মনে রাখিনা সে তথ্য আসলে আমরা জানিনা। যেমন যে তথ্য গুগলে বা অন্য কোনো সার্চ ইঞ্জিনে পাওয়া যায় তা আমরা আত্মস্থ করিনা। আর এ কারণেই আমরা গুগলে যা পড়ি তা থেকে আসলে আমরা কোনো জ্ঞান অর্জন করিনা।আর তাই প্রয়োজনের সময় সেসকল তথ্য আমাদের কোনো কাজেও লাগেনা।
গুগল ইফেক্ট কীভাবে কমিয়ে আনা যায়?
গুগলে যখনই কিছু সার্চ করবেন বা খুঁজবেন সেটা খুব মনোযোগের সাথে করতে হবে। শুধু কী-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করবেন না বরং যা জানতে চান তা পুরো বাক্য ব্যবহার করে লিখুন। যে ফল আসবে সেটি নিজেই নিজেকে পড়ে শুনান। যেমন, প্রথম নবাব বাংলা এগুলো না লিখে পুরো বাক্য লিখুন যেমন, বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব কে ছিলেন এটি লিখুন। আর যে উত্তরটি আসবে সেটিও পুরো বাক্যেই পড়ুন। যেমন, বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব ছিলেন মুর্শিদ কুলি খান।
দ্বিতীয়ত, যে উত্তরটি আসল সেটি মনে রাখার জন্য জুরে জুরে পড়ার সময় কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করুন। যেটি আপনাকে মনে রাখতে সাহায্য করবে। যেমন ডেস্কে কয়েকবার টুকা মারতে মারতে বলতে পারেন যে বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলি খান।
তৃতীয়ত, আপনি নতুন যে তথ্যটি জানলেন সেটি কাগজে কলম দিয়ে লিখে ফেলুন।
কীবোর্ডে টাইপ করবেন না। কারণ আপনি যখন আপনার হাত এবং মাংসপেশি ব্যবহার করে কলম বা পেন্সিল ঘুরিয়ে কোনো কিছু লিখেন তখন সেটি আপনার মস্তিষ্কে জোরালো সংযোগ তৈরি করে। সবচেয়ে ভাল আপনি যে তথ্যটি জানতে বা শিখতে চান সেটি সার্চ ইঞ্জিন নয় বরং অন্য কোনো সূত্র থেকে শিখতে চেষ্টা করুন। কোনো বিষয়ের বিস্তারিত জানতে হলে বই, জার্নাল বা কোনো বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করুন। উদাহরণ হিসেবে বলা হয় কোনো রাস্তা চিনতে হলে সেটি হেটে হেটে কিংবা ড্রাইভ করে গিয়ে চিনুন। কোনো রান্নার রেসিপি জানতে হলে রান্না করে শিখুন, ভিডিও দেখে নয়। যদি কোনো তথ্য ভুলে যান তাহলে আগের মতই বার বার করুন। করার সময় বিভিন্ন টোন ও স্বরে পড়ুন, মনে থাকবে। আজ যে বিষয়টি পড়লেন সেটি ঝালাই করতে নিজেকে আগামীকাল সেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করুন। যা মনে নেই তা চাইলে আরেকবার পড়ে নিতে পারেন।