অবাক বিশ্ব

চোরাবালি কী? চোরাবালিতে পড়ে গেলে কী করবেন?

চোরাবালি কী?

চোরাবালি আসলে সাধারণ বালির মতোই এক ধরনের বালি। কিন্তু সাধারণ বালির সাথে একটি বড় পার্থক্যও আছে এর। পার্থক্য হলো এই বালি পানি দ্বারা অতি-সম্পৃক্ত হয়ে থাকে (কমেন্ট বক্সে ছবি আছে একটি)। আমরা যখন সাধারণ বালির উপরে দাঁড়াই, তখন পা কিছুটা ভেতরে ঢুকে গেলেও বেশিদূর যেতে পারে না। এর কারণ, বালিতে থাকা ঘর্ষণ বল আমাদেরকে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে পানি দ্বারা প্রচুর পরিমাণে সম্পৃক্ত হবার দরুন চোরাবালিতে এই বল সাধারণ বালির তুলনায় অনেক কমে যায়। এর ফলে পানি ও মাটি মিশ্রিত হয়ে স্যুপের মতো হয়ে যায়। যখন পানি ঝরঝরে-আলগা বালির মধ্যে আটকা পড়ে, তখন এটি তরলীকৃত মাটি তৈরি করে। ফলে এই মাটি কোনো ধরনের ভার বহন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর এরকম প্রাকৃতিক কারণেই মূলত তৈরি হয় ‘চোরাবালি’ নামক ফাঁদের।

⭕ সাধারণভাবে আমরা চোরাবালি বলতে বুঝি- যখন বালি, কাদা বা নুড়ি গর্ভস্থ পানির প্রবাহের সান্নিধ্যে আসে, সেই বালি বা নুড়ির দানাগুলোর মধ্যে যে ঘর্ষণ শক্তি থাকে তা কম হয়ে যায়, আর সেই বালি বা মাটি ভার সহ্য করতে পারে না- তাই চোরাবালি।

পানি শুধু মাটির উপরেই না মাটিন নিচেও থাকে। প্রাকৃতিকভাবে ভূগর্ভে পানি থাকার এই ঘটনা ঘটে দুই ভাবে-

১- Flowing underground water/spring
২- Earthquake।

এই আটকে পড়া পানি তার চারপাশের মাটিকে সিক্ত করে। এভাবে তরল হতে হতে এক পর্যায়ে বালির অণুগুলোর মধ্যে যে স্ফীত স্থান থাকে তা কমে যায় এবং বালি পানির অণুর মত আচরণ করে। ভেজা এই বালি এক পর্যায় এমন অবস্থায় যায় যে সে কোন ভারি বস্তুর চাপ নিতে পারে না।

তরল কাদায় কিছু পড়লে তা দ্রুত ডুবে যায় কিন্তু চোরাবালিতে কিছু পড়লে তা ধীরে ধীরে ডুবে।

এ ধরনের ব্যাপার আমরা সমুদ্র সৈকতে দেখতে পাই। সমুদ্রধারের বালিতে যদি কেও দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে খানিকক্ষণ পর দেখা যাবে যে ধীরে ধীরে তার পা বালির ভেতর বসে যাচ্ছে। এটাও এক ধরনের ছোটখাটো চোরাবালি। তবে এ ধরনের চোরাবালির গভীরতা মাত্র কয়েক ইঞ্চি হয়। তাই সেসব স্থানে শুধু আমাদের পায়ের পাতা ডোবে। তবে যে সব স্থানে এর গভীরতা বেশি সেসব স্থান খুবই ভয়ংকর।

চোরাবালি পানি ও তরল কাদা মিশ্রিত এমনই একটি গর্ত, এর ফাঁদে একবার পা দিলে আর নিস্তার নেই। আস্তে আস্তে ডুবে যেতে হয় বালির ভেতর। যত নড়াচড়া হয় ততই ডুবে যেতে থাকে শরীর।

সাধারণত নদী বা সমুদ্রতীরে কাদা মিশ্রিত বালির ভেতরে লুকানো অবস্থায় থাকে চোরাবালি। কোনও মানুষ যদি সেই গর্তের ধারে-কাছে যায়, তাহলে শরীরের চাপে ওই বালি ক্রমে সরে যেতে থাকে। ফলে মানুষ শত চেষ্টা করেও আর ওপরে উঠে আসতে পারে না। চোরাবালিতে পড়ার পর সেখান থেকে উঠে আসার জন্য চেষ্টা করলে শরীরের চাপে আরও দ্রুত ডুবে যেতে হয়। সময়মতো কেও এগিয়ে না এলে ওই মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ে। তবে অধিকাংশ চোরাবালি সাধারণত মারাত্মক নয়। তবে এটি প্রকৃতির একটি অদ্ভুত বিস্ময়।

যেসব জায়গায় পানি বেশি, সেসব জায়গায় চোরাবালি থাকার সম্ভাবনাও বেশি। যেমন জলা, নদী, খাল, সমুদ্রতীর এবং জলাভূমি। যেসব জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ থাকে সেখানে চোরাবালি থাকতে পারে বা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

চোরাবালিতে আটকে গেলে একদমই অধৈর্য হওয়া যাবে না। অধৈর্য হয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করলে আরও বেশি আটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সবার মনে রাখা উচিত, চোরাবালি কিন্তু পানির চেয়ে অনেক বেশি ঘন। তাই চোরাবালিতে ভেসে থাকা পানির চেয়ে অনেক বেশি সহজ। যদি সঙ্গে কোনও ভারি বস্তু থাকে তাহলে তা ছেড়ে ফেলতে হবে। কারণ ভারি বস্তু আরও বেশি দ্রুত নিচে টেনে নিতে পারে।

মানুষের শরীরের ঘনত্ব প্রতি কিউবিক ফুটে সাধারণত ৬২.৪ পাউন্ড। চোরাবালির ঘনত্ব পানির থেকে বেশি। অর্থাৎ মানুষ যদি পানিতে ভেসে থাকতে পারে, তাহলে চোরাবালিতেও অনায়াসে পারবে, যেহেতু চোরাবালির ঘনত্ব পানির থেকে বেশি। তাই চোরাবালিতে পড়ে গেলে একদম নড়াচড়া করা যাবে না। যত নড়াচড়া হবে তত ডুবে যাবার আশংকা বাড়বে। চোরাবালি শুধু সমুদ্র সৈকতেই থাকে না। নদীর পাড়ে, হাওর এর আশে পাশেও থাকতে পারে।

বেশিরভাগ চোরাবালির গভীরতা কম হয়। খানিকটা ডোবার পর হয়তো পা তলায় আটকে যেতে পারে। যদি তা না হয়, মানে যদি চোরাবালি খুব গভীর হয় তাহলে পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

চোরাবালির গঠন।

চোরাবালির ফাঁদে পড়লে যে ব্যাপারগুলো মনে রাখবেন:

১. আপনি মারা যাচ্ছেন না, এটা নিশ্চিত!

২. আপনি যতটা বল প্রয়োগ করবেন, ততটাই ঐ ফাঁদে ফেঁসে যাবেন। তাই নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। কখনোই হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করবেন না। এই কাজ করলে আপনি শুধু একটাই সাফল্য পাবেন- আপনি নিজেকে চোরাবালির আরও গভীরে নিয়ে যাবেন!

৩. মানবদেহের ঘনত্ব প্রতি ঘনফুটে ৬২.৪ পাউন্ড। আর এই ঘনত্ব নিয়েই আমরা দিব্যি পানিতে ভেসে থাকতে পারি। অন্যদিকে চোরাবালির ঘনত্ব প্রতি ঘনফুটে ১২৫ পাউন্ড। তার মানে বুঝতেই পারছেন, পানির চেয়েও অনেক সহজে ভেসে থাকা যাবে চোরাবালিতে!

বাঁচার উপায়

আপনি যদি ঘটনাক্রমে চোরাবালিতে পড়েও যান, তাহলে আপনার প্রথম কাজটি হবে- আতঙ্কিত না হওয়া। আগেই বলেছি, চোরাবালি কয়েক ফুটের বেশি গভীর হয় না। তাই চোরাবালিতে পড়ে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনার জুতা জোড়া হারানোর সম্ভাবনাই প্রকট! এখন তাহলে চোরাবালি থেকে পরিত্রাণ পাবার পদ্ধতিতে যাওয়া যাক। প্রথমত, আপনার কাঁধে কোনো ব্যাগ থাকলে তা খুলে ফেলার চেষ্টা করুন। আপনার ভর যত কমবে ততই ভালো। একইসাথে চেষ্টা করুন পায়ের জুতাও খুলে ফেলতে। জুতা থাকলে সেটা আংটার মতো কাজ করতে পারে এবং আপনাকে চোরাবালি থেকে বের হতে একটু বেশিই পরিশ্রমে পড়তে হতে পারে। অবশ্য পায়ের জুতা খুলে ফেলা সম্ভব না হলেও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই, একটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে, এ-ই যা!

প্রসঙ্গত একটা কথা বলে রাখা ভালো, চোরাবালিতে পুরো শরীর নিয়ে না পড়ে যদি কখনো এক পা পড়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে পিছনে ফিরে আসুন। চোরাবালি প্রায় এক মিনিট সময় নেয় তরলিত হওয়ার জন্য। আপনি সচেতন থাকলেই নিজের পা-কে ঐ সময়ের মধ্যে বের করে নিয়ে আসতে পারবেন।

আর আপনি যদি চোরাবালিতে পুরো দেহসমেত পড়েই যান, তাহলে আরো কিছু কাঠখড় পোড়াতেই হবে। চলুন অন্য একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করি। ধরুন, আপনি চোরাবালিতে না পড়ে একটি বিশাল বড় পুকুরে পড়ে গেছেন। তখন আপনি কী করবেন? সাঁতরে পাড়ে ওঠার চেষ্টা করবেন অবশ্যই। একই কাজ করতে হবে চোরাবালির ক্ষেত্রেও। নিজের দেহকে আনুভূমিক করে পিঠের উপর ভর দেয়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনার শরীরের ভর সমানভাবে বণ্টন হবে। এর ফলে আপনি সহজে ভেসে থাকতে পারবেন। এরপর মূলত আপনাকে চিৎসাঁতার দিতে হবে! নিজের পা দুটোকে ঝাঁকিয়ে পায়ে লেগে থাকা বালিগুলোকে আলগা করার চেষ্টা করুন এবং ধীরে ধীরে সেগুলোকে উপরে নিয়ে আসার চেষ্টা করুন। সাঁতারে যেভাবে হাতকে কাজে লাগান ঠিক সেভাবে এখানেও করার চেষ্টা করুন। তবে সাবধান! নিজের হাত দুটোকে ডুবিয়ে একসাথে করবেন না যেন। তাহলে ওগুলো আবার চোরাবালিতে আটকে যেতে পারে! এভাবে সাঁতরে আপনি যখন একটু শক্ত মাটির নাগাল পাবেন, নিজেকে টেনে বের করে নিয়ে আসুন।

চোরাবালি কি সত্যিই আপনাকে মেরে ফেলতে পারে?

একটু ভাবুন তো, আপনি এরকম ক’টি সিনেমা দেখেছেন যেখানে নায়ক চোরাবালির মধ্যে পড়ে যায়, আর ঠিক শেষ মুহূর্তে হয়তো গাছের ডাল ধরে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে বের হয়ে আসে? সিনেমাতে যদি না-ও দেখে থাকেন, গল্পে চোরাবালির কথা পড়েননি কিংবা চোরাবালির নাম অন্তত শোনেননি এমন কাউকে হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে সিনেমাতে দেখে থাকা চোরাবালির দৃশ্যকে সত্যি ভেবে বসলে হয়ত কারও কাছে একে কোনো মারাত্মক গভীর কোনো গহ্বর মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে চোরাবালির গভীরতা কয়েক ফুটের বেশি হয় না। বলা বাহুল্য, এই কয়েক ফুট গভীরতাই যে কারো মনে মৃত্যু-শঙ্কা তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। আপনি যদি চোরাবালিতে কখনো পড়েও যান, সেখানে কেউ কিন্তু আপনাকে ভেতরের দিকে নিয়ে যাবে না। চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়ার কাজটি করবেন আপনি নিজেই! অদ্ভুত ঠেকছে না ব্যাপারটা?

তাহলে কি চোরাবালিকে একদম ভয় পাবেন না?

চোরাবালি যে একদম অহিংস- এমন বলা যাবে না। আবার অত্যন্ত বিপদজনক- এ কথাও বলা যাবে না। নিজে নোংরা হওয়া, জুতা কিংবা কাঁধের ব্যাগ হারানোর থেকে তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা এতে তেমন নেই। কিন্তু ব্যাপারটা মারাত্মক হতে পারে এতে আটকা পড়ার জায়গার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। চোরাবালিতে আটকা পড়ার পর মৃত্যুর খবরও শোনা যায়নি, এমন বলা যাবে না। সমুদ্রের তীরে চোরাবালিতে আটকা পড়ে পরবর্তীতে সমুদ্রে ঢেউয়ের কারণে মারা যাওয়ার ঘটনাও শোনা গেছে। আবার জনমানবহীন জায়গায় চোরাবালিতে আটকা পড়ে যদি নিজেকে উপরে তুলে আনতে কেউ ব্যর্থ হন, তাহলে সেটাকেও যথেষ্ট বিপদজনক বলতে হবে। তাই বলা যায়, মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করলে আপনার তেমন কোনো ক্ষতিই হবে না চোরাবালি থেকে।

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button