চিকিৎসা

কীভাবে শনাক্ত করা হয় করোনাভাইরাস আছে কি নেই

কোভিড-১৯ নামক মহামারির বদৌলতে আজ বিশ্বজুড়ে সবাই একনামে চেনে করোনাভাইরাসকে। সাধারণ সর্দি-জ্বর-কাশি দিয়ে শুরু হলেও ভাইরাসটি ফুসফুসে গিয়ে ভয়ংকর মাত্রার নিউমোনিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ফলস্বরূপ, আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। বলা হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশা কমালে এই সংক্রমণ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। সেই লক্ষ্যেই পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের মানুষ আজ ঘরে থেকে কাজ করছে, একজন আরেকজনকে স্পর্শ করতেও ভয় পাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী এর পরের গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি হলো—যত বেশি সম্ভব নমুনা পরীক্ষা করে যাদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ আছে, তাদের খুঁজে বের করা। ভাইরাসটি দেহের মধ্যে আছে কিনা জানা থাকলে ওই মানুষটিকে কিছুদিন আলাদা করে রাখতে হবে। এতে তার থেকে আর ভাইরাসটি অন্য কারও দেহে ছড়াতে পারবে না। বাংলাদেশে এরই মধ্যে ভাইরাসটি অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাস বহনকারীদের শনাক্ত করা এবং প্রয়োজনমতো তাদের আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট হলেও তা বাস্তবায়ন করা এমন জনবহুল দেশের জন্য কঠিন বটে।

কোভিড-১৯ পজিটিভ কি না, তা নির্ণয়ের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ও সংবেদনশীল পদ্ধতি হচ্ছে RT-PCR বা রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পিসিআর। এই পদ্ধতিতে আমাদের কোষের মধ্যে থাকা আরএনএকে ডিএনএতে পরিণত করে তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তা মেশিনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও গণনা করা যায়। আমাদের ডিএনএ মাত্র চারটি অক্ষর দিয়ে লিখিত। অ্যাডিনোসিন (এ), সাইটোসিন (সি), থাইমিন (টি), গুয়ানিন (জি)—এই চারটি ক্ষারীয় যৌগের বিভিন্ন রকম বিন্যাস নির্ধারণ করে দেয় কোন জিনের কী কাজ। এই ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরি হয় এবং আরএনএ থেকে তৈরি হয় প্রোটিন, যা আমাদের দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশের জন্য দায়ী। যেমন চোখের রং কালো না নীল—এই ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিন্নতার জন্য দায়ী হচ্ছে ডিএনএর ক্রমবিন্যাসের ভিন্নতা।

করোনাভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস। অর্থাৎ তার জিনোম ডিএনএ নয় আরএনএ দিয়ে তৈরি। এই জন্য কোনো মানুষের দেহে এই ভাইরাসটি আছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা মানুষটির সর্দি বা কাশির থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সেই কোষগুলো থেকে আরএনএ আলাদা করতে পারি। যদি ভাইরাসের সংক্রমণ থাকে তাহলে অবশ্যই মানুষটির নিজের আরএনএর সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসটির আরএনএটিও আমাদের নমুনায় চলে আসবে। এরপর RT-PCR নামক পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা আরএনএ থেকে এর একটি ডিএনএ প্রতিলিপি তৈরি করে সেই ডিএনএকে বহুগুণে বাড়িয়ে ফেলতে পারি। ভাইরাসের নিজের দেহে ডিএনএ না থাকলেও আমরা পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে এর আরএনএ থেকে ডিএনএ-স্বরূপ একটি প্রতিলিপি তৈরি করতে পারি। দেহের ভেতরে ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরির প্রক্রিয়াটিকে বলে ট্রান্সক্রিপশন এবং এর বিপরীত অর্থাৎ আরএনএ থেকে ডিএনএ তৈরির প্রক্রিয়াটি হলো রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন, যা রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ নামক একটি এনজাইমের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এই থেকে RT-PCR নামের প্রথম অংশের উৎপত্তি।

দ্বিতীয় অংশ, অর্থাৎ PCR নামের অর্থ জানতে আমাদের পরিচিত হতে হবে পলিমারেজ নামের আরেকটি এনজাইমের সঙ্গে। পলিমারেজ হচ্ছে সেই এনজাইম, যা ডিএনএ থেকে আরও ডিএনএ তৈরি করতে পারে। আমাদের দেহের ভেতরে পলিমারেজ এনজাইম প্রতিনিয়ত ডিএনএ থেকে ডিএনএর প্রতিলিপি বানিয়েই চলছে। পলিমারেজ এনজাইম দিয়ে পরীক্ষাগারে পিসিআর মেশিনের সাহায্যে একটি ডিএনএ থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি এভাবে সূচক-হারে ডিএনএ অণুর সংখ্যা লক্ষ-কোটি গুণ বাড়ানো সম্ভব। যেমন এমন পাঁচটি চক্রের পর ডিএনএ বেড়ে যাবে ২৫ অর্থাৎ ৩২ গুণ এবং ২০টি চক্রের পরে ২২০ = ১০,৪৮,৫৭৬ গুণ। এবার নিজেরাই চিন্তা করে দেখুন ৪০টি চক্রের পর ডিএনএর সংখ্যা কতগুণ বেড়ে যাবে। এই আনুপাতিক হারে ডিএনএর সংখ্যা বাড়ানোর প্রক্রিয়াটিকে বলে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন বা PCR।

কিন্তু এই রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ ও পলিমারেজ এনজাইমগুলো মানুষের আরএনএ ও করোনাভাইরাসের আরএনএর মধ্যে তফাৎ করবে কীভাবে? এর জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে আবার জিনোমের বিন্যাসের দিকে। করোনাভাইরাসের সুন্দর crown আকৃতির ছবিটি এখন বেশ পরিচিত সবার কাছে। এদের কিছু বিশেষ প্রোটিন থাকে, যাদের নিউক্লিওক্যাপসিড বলে। এ ছাড়া আরও কিছু প্রোটিন থাকে, যা এই ভাইরাসটির জন্য স্পেসিফিক এবং মানুষের দেহে অনুপস্থিত। ওই বিশেষ প্রোটিনগুলো আরএনএ জিনোমের যে অংশ থেকে তৈরি হয়, তার দু পাশের কিছু অংশের বিন্যাস বা সিকোয়েন্স বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে বের করে ফেলেছেন ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে। ফলে এই বিশেষ জিনগুলোর দু পাশের কিছু অংশও (~১৮-২৫ নিউক্লিওটাইড) আমরা কৃত্রিমভাবে তৈরি করে পলিমারেজ এনজাইমের সঙ্গে মেশিনের মধ্যে দিয়ে দিই, যাকে প্রাইমার বলে। তখন পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে শুধুমাত্র ওই ভাইরাস স্পেসিফিক বিশেষ জিনটির পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

এই প্রক্রিয়াটি খুবই সংবেদনশীল, ফলে খুব সামান্য পরিমাণের ভাইরাসের আরএনএ উপস্থিত থাকলেও তা বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা তার উপস্থিতি ঠিকই টের পেয়ে যাই। একজন মানুষের কাছ থেকে নেওয়া নমুনার ওপর সাধারণত ভাইরাসের দুটি জিনের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয় এবং সেই সঙ্গে মানুষের জিনোম স্পেসিফিক আরেকটি জিনের উপস্থিতি খতিয়ে দেখা হয়, যা ভাইরাসের জিনোমে থাকে না। প্রথম দুটি জিনের উপস্থিতি ভাইরাসটির উপস্থিতি নির্ণয় করবে এবং মানুষের দেহের জিনটির উপস্থিতি প্রমাণ করবে যে, নমুনা থেকে ঠিকমতো আরএনএ আলাদা করা থেকে শুরু করে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন এবং PCR-এর সবগুলো ধাপ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে কি না।

অনেক সময় ভাইরাসের উপস্থিতির রেজাল্ট নেগেটিভ আসতে পারে। তখন যাতে পরীক্ষাটি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ না থাকে, সে জন্য মানুষের জিনটির PCR এক ধরনের কন্ট্রোল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রথম দুটি নেগেটিভ, কিন্তু মানুষের জিনটির উপস্থিতি পজিটিভ হলে রোগীর কোভিড-১৯ নেই বলে ধরা হয়। আবার প্রথম দুটি পজিটিভ কিন্তু মানুষের জিনটির উপস্থিতি অনেক সময়ে নেগেটিভ আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভাইরাসের যেকোনো একটি জিনের জন্য PCR পজিটিভ এলেই নমুনাটি কোভিড-১৯ পজিটিভ-এর সন্দেহের তালিকায় রাখা হয় এবং প্রয়োজনে পুনরায় PCR পরীক্ষা করা যেতে পারে।

মানুষের জিনটির উপস্থিতি অনেক সময় আরএনএ কম পরিমাণে থাকলে নাও আসতে পারে। কিন্তু যদি তিনটি PCR-ই নেগেটিভ আসে অর্থাৎ ডিএনএ বৃদ্ধি হতে না পারে, তাহলে আবার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করতে হবে। এখানে বলে রাখা উচিত যে, PCR-এর পজিটিভ বা নেগেটিভ ফলাফলের সঙ্গে সঙ্গে রোগীর মধ্যে রোগের কী কী লক্ষণ দেখা গেছে, তার অন্য কোনো অসুখ আছে কি না এবং আনুষঙ্গিক লক্ষণসমূহ বিবেচনা করে, তবেই রোগীর কোভিড-১৯ আছে কি নেই তা নির্ণয় করতে হবে। PCR-এর জন্য নমুনাগুলো তৈরি করার সময় প্রতিটি ধাপে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে মেশিনে বসানোর আগে পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে এ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কোনোভাবে একটি নমুনার সঙ্গে আরেকটি নমুনা মিশে গেলে PCR-এ ‘ফলস পজিটিভ’ ফলাফল আসতে পারে। অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে রোগীর কোভিড-১৯ না থাকলেও রেজাল্ট আসতে পারে যে—তার আছে। আবার নমুনাগুলো সংগ্রহের সময় সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে বা ঠিকমতো সংরক্ষণ না করলে বা জিনে কোনো ধরনের মিউটেশন বা পরিবর্তন থাকলে প্রাইমারটি ঠিকমতো সংযুক্ত হতে পারে না ডিএনএর সঙ্গে। এ ক্ষেত্রেও PCR-এ ‘ফলস নেগেটিভ’ রেজাল্ট আসবে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে রোগীর কোভিড-১৯ থাকলেও রেজাল্ট আসতে পারে যে, তার রোগটি নেই; যেটা রোগীর সঠিক চিকিৎসার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ জন্য এই রোগ নির্ণয়ের প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করতে হয়।

RT-PCR-এর বেসিক ছিল এটুকু। কিন্তু এই যে ডিএনএ বহুগুণে বৃদ্ধি পেল, আমরা কীভাবে এটি মানস চোখে দেখতে পারব? সাধারণত PCR করে আমরা এক ধরনের জেলের মধ্যে ইলেকট্রিসিটির সাহায্যে PCR product-কে গতিশীল করে ডিএনএতে সংযুক্ত হতে পারে-এমন কিছু কেমিক্যালের সাহায্যে UV রশ্মির নিচে এর উপস্থিতি দেখতে পারি। এই সিস্টেমটি বাংলাদেশের বেশির ভাগ মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবরেটরিতেই আছে। কিন্তু রোগীর নমুনা পরীক্ষার জন্য প্রতিবার PCR করে জেলের মাধ্যমে দেখাটা বেশ সময় এবং শ্রমসাপেক্ষ। এ জন্য আমাদের দরকার হয় RealTime-RT-PCR নামের আরেকটি আধুনিক PCR মেশিন। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পলিমারেজ এনজাইম, নমুনার আরএনএ ও প্রাইমারের সঙ্গে কিছু ফ্লুরোসেন্ট ডাই সংযুক্ত করে দিতে হয়। পলিমারেজ এনজাইমের সাহায্যে ডিএনএ যখন এক সূত্রক থেকে দ্বিসূত্রক হয়, তখন এই প্রাইমার বা প্রোবের সঙ্গে লাগানো ফ্লুরোসেন্ট ডাইগুলো বিশেষ একটি তরঙ্গে আলো বিকিরণ করে, যা এই RealTime-RT-PCR মেশিনটির মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই। ডিএনএর সংখ্যা যত বাড়তে থাকে এই বিকিরণের পরিমাণও তত বাড়তে থাকে। আমরা তখন বাস্তবিক অর্থেই স্বচক্ষে মেশিনের মনিটরে ডিএনএর এই সংখ্যা বৃদ্ধিটুকু দেখতে পাই। ফলে খুব অল্প সময়েই আমরা ভাইরাসটির উপস্থিতি একটি ‘এস’ আকৃতির গ্রাফের মাধ্যমে দেখতে পাই। আর অনুপস্থিত থাকলে ডিএনএও বৃদ্ধি পাবে না, গ্রাফটিও তৈরি হবে না। ফলে কী পরিমাণে ডিএনএ বৃদ্ধি পেল, সে সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায় দেখে একে quantitative RT-PCR-ও বলা হয়ে থাকে। তবে রোগীর নমুনাতে ভাইরাসের জিনের উপস্থিতি আছে কি নেই সেটুকু দেখাই রোগ ডায়াগনোসিসের জন্য যথেষ্ট।

RealTime-RT-PCR মেশিন বেশ দামি হলেও বাংলাদেশের অনেক গবেষণাগারেই এই মেশিন রয়েছে, যা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা গবেষণার কাজ করে থাকেন। মহামারির মতো দুর্যোগকালীন সময়ে এই মেশিনগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই মেশিনগুলোতে সাধারণত ৯৬টি টেস্ট করার মতো জায়গা (well) থাকে। মেশিনের ব্র্যান্ড ভেদে ৩৬ থেকে শুরু করে ৩৮৪টি টেস্ট করার মতো জায়গাও থাকে। রোগীর নমুনা পরীক্ষার সময় সব সময় একটি পজিটিভ ও একটি নেগেটিভ কন্ট্রোল দিতে হয়। পজিটিভ কন্ট্রোল অর্থ হচ্ছে এটি সব সময় পজিটিভ ফল দেখাবেই, সাধারণত যা নেওয়া হয় করোনাভাইরাসের আরএনএ থেকে। নেগেটিভ কন্ট্রোল সব সময় নেগেটিভ ফল দেখাবে; এটা হতে পারে সাধারণ স্টেরাইল স্যালাইন যাতে কোনোভাবেই ভাইরাসের বা মানুষের আরএনএ আসার কোনো সুযোগ নেই।

প্রতিটি রোগীর নমুনা থেকে আমাদের কমপক্ষে তিনটি পরীক্ষা করতে হয়। সুতরাং এভাবে ৯৬ well-এর একটি মেশিন একবার চালালে আমরা ৩০টির মতো রোগীর নমুনা পরীক্ষা করতে পারব। এ পরীক্ষা সম্পন্ন হতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এক দিনে মেশিনটি একাধিকবার চালানো যায়। তবে multiplexing নামক একটি ব্যবস্থার ফলে আমরা একসঙ্গে ৯০ জন রোগীর নমুনাও ৯৬ well-এর মেশিনে পরীক্ষা করতে পারব। multiplexing প্রক্রিয়াতে আমরা একজন রোগীর নমুনার জন্য যে তিনটি জিনের RT-PCR করব, তাদের প্রাইমারগুলোর সঙ্গে তিন ধরনের ফ্লুরোসেন্ট ডাই সংযুক্ত করে দিতে পারি। ফলে মেশিন একটি well-এর মধ্যে দেওয়া নমুনাতেই তিন ধরনের ফ্লুরোসেন্ট শনাক্ত করে তিনটি ভিন্ন রঙের গ্রাফ দেখাবে। ফলে আমাদের তিনটি জিনের জন্য আলাদা well ব্যবহার করতে হচ্ছে না। তাই প্রয়োজন হলে একটি মেশিনের মাধ্যমে এক দিনে কমপক্ষে ১৮০ বা ততোধিক নমুনাও পরীক্ষা করা যায়। দক্ষ হাতে যথেষ্ট জনবল নিয়ে কাজ করলে এক দিনে আরও অনেক বেশি নমুনাও পরীক্ষা করা সম্ভব। তবে অবশ্যই নমুনা সংগ্রহ থেকে PCR পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে যেন প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

RealTime-RT-PCR-এর জন্য যে রিঅ্যাজেন্ট ব্যবহার করা হয়, তার ভিন্নতার কারণে অনেক সময়ে ডায়াগনোসিস এর খরচ কম-বেশি হতে পারে। সাইবার গ্রিন নামের আরেক ধরনের ফ্লুরোসেন্ট ডাই ব্যবহার করে দক্ষিণ কোরিয়ার একদল বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, কীভাবে খরচ কমিয়ে আনা যায়। এ ছাড়া ভাইরাসের উপস্থিতি LAMP নামের আরেক ধরনের PCR-এর মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। সাধারণ PCR-এর সময় প্রতিটি সাইকেল বা চক্রে তিনটি ধাপ সম্পন্ন হয়। প্রথমে ~৯৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় দ্বিসূত্রক ডিএনএ আলাদা হয়ে একসূত্রক হয়, এরপরে ~৫৫-৬৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কৃত্রিমভাবে তৈরি করা প্রাইমারগুলো ডিএনএর নির্দিষ্ট জিনের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ~৬৫-৭২ ডিগ্রিতে পলিমারেজ এনজাইমের সাহায্য প্রতিটি একসূত্রক ডিএনএ থেকে দ্বিসূত্রক ডিএনএ তৈরি হয়। অর্থাৎ PCR-এ যদি ৪০টি সাইকেল দেওয়া হয়, তাহলে এই তিনটি ধাপ ৪০ বার করে হবে, যা কিছুটা সময়সাপেক্ষ। LAMP-এ বিশেষ এক ধরনের পলিমারেজ ব্যবহার করা যায়, যা নিজে নিজেই দ্বিসূত্রক ডিএনএকে ভেঙে একসূত্রক বানাতে পারে। ফলে বিভিন্ন তাপমাত্রার তারতম্য করতে তিনটি ধাপের প্রয়োজন হয় না। মাত্র একটি তাপমাত্রাতেই বেশ কম সময়ে এটি সম্পন্ন হতে পারে।

PCR মেশিনের প্রধান কাজ হচ্ছে, তাপমাত্রার এই ওঠা-নামা নিয়ন্ত্রণ করা। সুতরাং হাতের কাছে PCR মেশিন না থাকলেও প্রয়োজনে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গরম পানির water bath তৈরি করে তার মধ্যে নমুনার টিউবগুলো পলিমারেজ, প্রাইমার ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে রেখে দিলেও PCR করা সম্ভব। এতে ৬ ধরনের প্রাইমার একসঙ্গে ব্যবহার করে এক ধরনের লুপ তৈরি করে। তারপর ডিএনএর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এ জন্য একে বলে Loop-Mediated Isothermal Amplification। তবে বেশির ভাগ জায়গাতেই এখন পর্যন্ত রোগ নির্ণয়ের জন্য RealTime-RT-PCR-ই বেশি করা হচ্ছে।

একজন মানুষের দেহে ভাইরাস প্রবেশের পর তার দেহের ইমিউন সিস্টেম চেষ্টা করে সেই ভাইরাসটিকে মেরে ফেলতে। এ জন্য মানবদেহ নিজেই ভাইরাসের বিভিন্ন পার্টিকেলের (অ্যান্টিজেন) বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে হতে ১৪-২১ দিন লেগে যেতে পারে। তত দিনে হয়তো রোগীর শারীরিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। সুতরাং সঠিক সময়ে পরীক্ষা না করলে অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডির রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে উৎপাদিত অ্যান্টিবডি উপস্থিতির সেরোলজিক্যাল পরীক্ষা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেগেটিভ রেজাল্ট দেখাতে পারে। সার্স, মার্স, নভেল করোনাভাইরাস সবই করোনা জাতীয় ভাইরাস, ফলে খুব স্পেসিফিক অ্যান্টিবডি না হলে এ ক্ষেত্রে আসলে কোন ভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যান্টিবডিটা রিঅ্যাক্ট করছে, তা বলা মুশকিল। তবে এই প্রক্রিয়াটি বেশি ব্যয়সাপেক্ষ নয় এবং এপিডেমিওলজিকাল অ্যানালাইসিসের জন্য এটি কার্যকর। এ ছাড়া CRISPR ও সিকোয়েন্সিংভিত্তিক কিছু প্রক্রিয়া আছে, যা এখনো অধিকসংখ্যক নমুনার জন্য খরচসাপেক্ষ।

করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য এখন পর্যন্ত RT-PCR সবচেয়ে কার্যকরী প্রক্রিয়া বলে বিবেচিত। Multiplexing-এর মাধ্যমে একদিনে একটি মেশিনে অনেকগুলো নমুনা পরীক্ষা করা যায়। সেই হিসেবে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বা গবেষণাগারে একদিনে অনেকগুলো করে নমুনা পরীক্ষা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ, সঠিক নিরাপত্তা কেবিনেটের ব্যবহার, টেস্টের রেজাল্ট সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করে বিতরণ করা এবং সেই সঙ্গে থেকে যায় রিঅ্যাজেন্টের খরচের ব্যাপারটি। রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ, পলিমারেজ ইত্যাদি এনজাইম ভবিষ্যতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা গেলে এই খরচ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। নমুনা সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে তা এক ধরনের লাইসিস বাফারে রেখে দিলে ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তবে সংগ্রহের সময় অবশ্যই সঠিক পিপিই (Personal Protective Equipment) ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করার পরের বাকি কাজ বায়োসেফটি লেভেল-২ কেবিনেটেই করা সম্ভব। শুধু ভাইরাসটি কালচার করা বা পুনরায় সক্রিয় করার প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই বায়োসেফটি লেভেল-৩ কেবিনেট ব্যবহার করতে হবে।

যখন একটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে বা কেন্দ্রে রোগ নির্ণয়ের কাজ পরিচালিত হবে, তখন একটি মুখ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে তত্ত্বাবধান এবং তথ্যের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও বিতরণ। এ ক্ষেত্রে তথ্য ইনপুট দেওয়ার জন্য একটি পাসওয়ার্ড দ্বারা সুরক্ষিত ইন্টারনাল তথ্যভান্ডার বা ডেটাবেজ ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতিটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্রের প্রতিনিধির প্রবেশাধিকার থাকবে এবং তারা রোগীর অন্যান্য উপসর্গের সঙ্গে PCR রেজাল্ট পজিটিভ না নেগেটিভ সেই তথ্যগুলো মেইনটেন করতে পারবে। সঠিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমগ্র দেশের কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় রক্ষা করা যাবে। এতে মহামারির বিস্তার যেমন কমিয়ে আনা যাবে, তেমনি কোভিড-১৯ চিহ্নিত রোগীদের সঠিক সুরক্ষাও দেওয়া যাবে।

অদূর ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন চলে আসবে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু ভাইরাসটি যতবার নিজে নিজেই মিউটেশনের মাধ্যমে এর জিনোমের বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়েছে, কে জানে, অন্য দেশে উৎপাদিত ভ্যাকসিনটি আমাদের দেশের জনগণের জন্য কার্যকরী হবে কি না। বিশেষ করে আমাদের দেশে ভাইরাসটি বিস্তৃতি লাভ করেছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষেরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ার পর। ফলে হয়তো এ ক্ষেত্রে ভাইরাসটির জিনোমে নতুন কোনো বৈচিত্র্য থাকতে পারে। এই বৈচিত্র্যের কারণে প্রাইমার সংযুক্ত হতে না পারলেও ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট আসতে পারে, যা আরও ভয়ংকর। আমরা এ যাত্রা এর প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে পারলেও ভবিষ্যতে এটি আরও ভয়ংকর রূপে ফিরে আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের দরকার হবে বাংলাদেশে বিস্তৃত ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করা, রোগীদের রক্ত সংগ্রহ করে অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি-সংক্রান্ত গবেষণা করা—যাতে পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করে আমাদের দেশের মানুষের উপযোগী ওষুধ বা টীকা বানানো সম্ভব হয়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button