চিকিৎসা

শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ ও প্রতিরোধের উপায়

খুব বেশি না হলেও কিছু সংখ্যক শিশুকে জন্মত্রুটি বা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে দেখা যায়। জন্মগত ত্রুটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কনজেনিটাল এবনরমালিটি বলা হয়ে থাকে। কনজেনিটাল এবনরমালিটি বলতে  শিশুর শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিভিত্তিক অস্বাভাবিকতাকে বোঝায়। গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং পরিবেশগত কারণ এবং অন্য কারো কিছু কারণে এমনটা হয়ে থাকে।

শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ

শিশুর জন্মগত ত্রুটি বা কনজেনিটাল এবনরমালিটির প্রধান কারণ হচ্ছে ক্রোমোসোমের অস্বাভাবিকতা বা জেনেটিক এবনরমালিটি। জেনেটিক এবনরমালিটি ছাড়াও জন্মগত ত্রুটির আরো বেশ কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা আছে। তবে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না যে কারো রিস্ক ফ্যাক্টর থাকলেই তার গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটি হবে।

শিশুর জন্মগত ত্রুটি- রিস্ক ফ্যাক্টর

ইনফেকশন:

গর্ভাবস্থায় মা যদি কিছু ইনফেকশন যেমন টক্সপ্লাসমোসিস (এক ধরণের অণুজীব বাহিত রোগ যা কাঁচা অথবা আধা সিদ্ধ মাংস খাওয়া ও অন্যান্য মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে) এ আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে এর ফলে গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটি হতে পারে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় রুবেলা, চিকেনপক্স, (ভাইরাস বাহিত রোগ যা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়) এবং যৌনবাহিত রোগ যেমন সিফিলিস, সাইটোমেগালো ভাইরাস ইত্যাদির  সংক্রমণও শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ হতে পারে।

গর্ভকালীন বয়স/ গর্ভাবস্থায় মায়ের বয়স:

গর্ভাবস্থায় মায়ের বয়স যদি ৩৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভবতী মায়ের যদি বয়স ৩৫ অথবা তার চেয়ে বেশি হয় তখন গর্ভস্থ শিশুর ‘ডাউন্স সিনড্রোম’ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পূর্বের গর্ভাবস্থায় জন্মগত ত্রুটির ইতিহাস থাকলে:

পূর্বের শিশুর জন্মগত ত্রুটি থাকলে পরেরবার গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া পরিবারে কারো জন্মগত ত্রুটি থাকলে, এটিও জন্মগত ত্রুটির রিস্ক ফ্যাক্টর গুলোর মধ্যে একটি।

বাবা-মা যদি আত্মীয় হয়:

গবেষণায় দেখা গেছে শিশুর বাবা-মা যদি আত্মীয় হয়ে থাকেন অর্থাৎ তাদের মধ্যে যদি রক্তের সম্পর্ক থেকে থাকে সেক্ষেত্রে এটিও গর্ভস্থ শিশুর জেনেটিক এবনরমালিটির জন্য দায়ী হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ওষুধ গ্রহণ:

গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ গ্রহণ করলে তা গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ হতে পারে। কিছু কিছু ওষুধ প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলের মাধ্যমে শিশুর শরীরে পৌঁছে যায় এবং এর টেরাটোজেনিক ইফেক্টের কারণে শিশুর জন্মগত ত্রুটি হয়ে থাকে।

অন্যান্য:

গর্ভকালীন সময়ে ধূমপান বা মদ্যপান, প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও ফলিক এসিড গ্রহণ না করা, পরিবেশগত কিছু কারণ যেমন রেডিয়েশন ইত্যাদি কারণেও জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে। গর্ভবতী মায়ের যদি ডায়াবেটিস থাকে এবং সেটির যদি যথাযথ চিকিৎসা না হয় তাহলে এটিও শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ হতে পারে।

যে সকল জন্মগত ত্রুটি হয়ে থাকে

জন্মগত হৃদরোগ: জন্মগত হৃদরোগ বলতে হৃদপিণ্ডের গঠনগত ও কার্যগত অস্বাভাবিকতাকে বোঝায়। সাধারণত গর্ভাবস্থায় রুবেলা সংক্রমণ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, ধূমপান/ মদ্যপান, বংশগত বা হেরিডিটি এবং কিছু ওষুধ গ্রহণ শিশুর জন্মগত হৃদরোগের কারণ।

স্পাইনা বাইফিডা: একটি জন্মগত রোগ যেখানে স্পাইনাল কর্ডের চারিদিকে মেরুদণ্ডের হাড় বা ভারটিব্রা তৈরি হয় না এবং মেরুদন্ড ও তার আবরণ (মেনিনজেস) এর ইনকমপ্লিট ডেভলপমেন্ট হয়ে থাকে। স্পাইনা বাইফিডা।

ঠোঁট কাটা/ তালু কাটা: খুব বেশি না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মগত ভাবে ঠোঁট কাটা অথবা তালু কাটা শিশু জন্মগ্রহণ করতে দেখা যায়। এর রিস্ক ফ্যাক্টর গুলোর মধ্যে রয়েছে গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় ভিটামিন গ্রহণ না করা, জীনগত ও পরিবেশগত কারণ, ধূমপান অথবা মদ্যপান ইত্যাদি

ডাউন্স সিনড্রোম: গর্ভস্থ শিশুর শরীরে ক্রোমোসোমের অস্বাভাবিকতা ডাউন্স সিনড্রোম এর কারণ। এক্ষেত্রে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি এবং বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ ব্যাহত হয়। এরকম সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা ২০ বছর বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে ০.১% এরও কম এবং ৪৫ বছর বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে তা ৩% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

সেরেব্রাল পালসি: মস্তিস্কের যে অংশ চলাফেরা, সূক্ষ্ম কাজ বা ফাইন মোটর ফাংশান নিয়ন্ত্রণ করে সেখানের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে ‘সেরেব্রাল পালসি’ হয়ে থাকে। এর ফলে চলাফেরা, দাড়িয়ে থাকা এবং সূক্ষ্ম কাজ করার ক্ষমতা ব্যাহত হয়, এবং এটির তেমন কোন চিকিৎসা নেই। গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস সংক্রমণ অথবা প্রসবের সময় শিশুর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব সেরেব্রাল পালসির অন্যতম প্রধান কারণ।

অন্যান্য: কখনো কখনো জন্মগত ভাবে শিশুর শিশুর পায়ুপথ বা এনাস এ ছিদ্র থাকে না, চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটিকে বলা হয় ‘ইমপারফোরেটেড এনাস’। জন্মগত ত্রুটি গুলোর একটি ক্লাব ফুট। এক্ষেত্রে পায়ের মাংসপেশি ও হাড়ের অস্বাভাবিকতার জন্য শিশুর পায়ের গোড়ালি বেঁকে যায় এবং কখনো কখনো অন্য পা থেকে আক্রান্ত পা একটু ছোট থাকে। ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটিগুলোর মধ্যে ‘হাইপোস্পেডিয়াস’ একটি। এছাড়াও ছেলে শিশুদের জন্মগত ভাবে স্ক্রোটামে টেস্টিস না থাকলে এই অবস্থাটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘ক্রিপ্টোঅরকিডিজম’ বলা হয়। পরবর্তীতে অরকাইডোপেক্সি অপারেশনের সাহায্যে টেস্টিস স্ক্রোটামে

জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধের উপায়

  • গর্ভাবস্থায় নিয়মিত এন্টি ন্যাটাল চেকআপ করানো।
  • গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ মত প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও ফলিক এসিড গ্রহণ করা এবং নিয়মানুযায়ী টিকা গ্রহণ করা এবং অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
  • যৌনবাহিত রোগ সম্পর্কে জানা এবং এই ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া।
  • ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা অর্থাৎ ‘হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি’ এর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাবধানতা অবলম্বন করা।
  • গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ওষুধ গ্রহণ না করা এবং ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা।
  • নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহে এবং ৩৫ পরবর্তী গর্ভধারনে নিরুৎসাহিত করা
Facebook Comments

Related Articles

Back to top button