অবাক বিশ্ব

আগ্নেয়গিরি! ভূ-ত্বকের এক আশ্চর্য উদগীরণ।

আগ্নেয়গিরি হলো বিশেষ ধরনের পাহাড় যার ভেতর দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরের উত্তপ্ত ও গলিত পাথর, ছাই এবং গ্যাস বেরিয়ে আসতে পারে। এটি একটি ভৌগোলিক প্রক্রিয়া। কোনো কোনো ফাটল বা ছিদ্রপথ দিয়ে ভূগর্ভস্থ গরম বাতাস, জলীয় বাষ্প, গলিত শিলা, কাদা, ছাই, গ্যাস প্রবল বেগে বেরিয়ে আসে। নির্গত এই সকল পদার্থ ভূপৃষ্ঠের শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে দ্রুত ঠান্ডা হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে যার কিছুটা ফাটলের চারপাশে এসে ধীরে ধীরে জমা হয়ে মোচাকৃতি আকার ধারণ করে। তখন একে “আগ্নেয়গিরি” বলে। আগ্নেয়গিরি থেকে ভূগর্ভস্থ পদার্থের নির্গমনকে বলা হয় অগ্ন্যুৎপাত। আগ্নেয়গিরির বহিঃস্থ যে মুখ বা নির্গমনপথ দিয়ে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে, তাকে জ্বালামুখ বলে। প্রতি বছর প্রায় ৬০টি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে।

বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় অর্ধ সহস্র সক্রিয় বা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে। যেসমস্ত আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাতের কোনও সম্ভাবনা নেই, তাদেরকে মৃত বা নির্বাপিত আগ্নেয়গিরি বলে। এছাড়াও বর্তমানে সক্রিয় নয়, কিন্তু ভবিষ্যতে অগ্ন্যুদ্গী‌রণ করতে পারে, এমন আগ্নেয়গিরিকে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি বলে।

ভূত্বকে ফাটল দেখা দিলে, ভূত্বকের কোনও দুর্বল ছিদ্রপথ থাকলে, কিংবা ভূগর্ভের তরল শিলা ও চাপ বৃদ্ধি পেলে অগ্ন্যুৎপাত হতে পারে। অগ্ন্যুৎপাতের কারণে আকাশে ছাই ও বায়বীয় পদার্থের মেঘ তৈরি হতে পারে। সমুদ্রের মাঝেও আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হতে পারে। ভূ অভ্যনতরে সঞ্চিত তরল শিলাকে বলে ম্যাগমা, আর যে তরল শিলা ভূ পৃষ্ঠের বাইরে বেরিয়ে আসে তাকে বলে লাভা।

পৃথিবীর গঠনকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। আমরা বসবাস করি সবচেয়ে বাইরের স্তরে । এই স্তরকে বলা হয়  ক্রাস্ট (crust)  যার  পুরত্ব হল প্রায় ১৮ মাইল। এরপরের স্তরকে বলা হয় মেন্টল (mantle) যা প্রায় ১৮০০ মাইল বিস্তৃত ।  সবচেয়ে ভেতরের দিকের স্তরের নাম হল কোর  (core)। মেন্টল ও ক্রাস্ট এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে আছে  উত্তপ্ত ও গলিত পাথর, ছাই এবং গ্যাস। এই উপাদানগুলো কখনো কখনো  অতিরিক্ত তাপ ও চাপের ফলে পৃথিবীর ফাটল দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। একসময় কোন না কোন ফাটল বা ছিদ্রপথে গরম বাতাস, জলীয় বাষ্প, গলিত শিলা, কাদা, ছাই, গ্যাস প্রবল বেগে বেরিয়ে আসে। নির্গত এই সকল পদার্থ ভূপৃষ্ঠের ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে এসে দ্রুত ঠান্ডা হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে এবং মোচাকৃতি লাভ করে। তখন একে আগ্নেয়গিরি বলে। আগ্নেয়গিরির বহিঃস্থ যে মুখ বা নির্গমনপথ দিয়ে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে, তাকে জ্বালামুখ বলে।

অর্থাৎ আগ্নেয়গিরি হলো  মোচাকৃতির  একটি বিশেষ ধরনের পাহাড় যার ভেতর দিয়ে ভূ-অভ্যান্তরের উত্তপ্ত ও গলিত পাথর, ছাই এবং গ্যাস বেরিয়ে আসতে পারে। এটি একটি ভৌগোলিক প্রক্রিয়া।

এই গলিত শিলা, কাদা, ছাই পৃথিবীর অভ্যন্তরে যখন থাকে তখন তার নাম ম্যাগমা (Magma) আর বাইরে ভূপৃষ্ঠে এলেই নাম  হয়ে যায়  লাভা (Lava)।

লাভা বলতে কোনো আগ্নেয়গিরি থেকে নিঃসৃত গলিত উত্তপ্ত তরল বা তা থেকে জমাট বাঁধা পাথরকে বোঝানো হয়। কোনো কোনো গ্রহ এবং উপগ্রহের ভূ-অভ্যন্তরে লাভা  আছে। কেন লাভ উদগিরণ হয় এর উত্তর হলো প্রচন্ড চাপ আর তাপ সহ্য করতে না পেরেই এই লাভা বের হয়ে আসে । লাভা যখন কোনো আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসে তখন এর  তাপমাত্রা  থাকে সাধারনত  ৭০০° সেলসিয়াস থেকে ১২০০° সেলসিয়াস পর্যন্ত। আগ্নেয়গিরি থেকে বিস্ফোরণহীণভাবে উদগীরিত লাভা যখন ভূপৃষ্ঠে বয়ে যায় তখন তাকে লাভা প্রবাহ বলা হয়। এই লাভা জমাট বেঁধে আগ্নেয় শিলা গঠন করে। ধারনা করা হয়  লাভা  শব্দটি এসেছে  সম্ভবত ল্যাটিন শব্দ লাবেস (labes) থেকে এসেছে, যার অর্থ হল গড়িয়ে পড়া।  জানা যায় ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের  মে থেকে জুন মাসের  মাঝামাঝি কোনো সময়ে ফ্র্যন্সিস্কো জেরাও নামের এক ব্যক্তি ভিসুভিয়াস পর্বতের আগ্নুত্পাত সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এই লাভা শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।

আগ্নেয়গিরির প্ৰকার

উদগীরণ ক্ৰিয়ার ওপর নিৰ্ভর করে আগ্নেয়গিরিকে প্ৰধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়-

১. জাগ্ৰত (Active)- যেসব আগ্নেয়গিরির মুখে সদায় নিয়মিত ভাবে ধোঁয়া,ছাই,গলিত লাভা, গ্যাস থাকে,সেসকল আগ্নেয়গিরিকে জাগ্ৰত আগ্নেয়গিরি বলে৷ যেমন -ছিছিলব মাউণ্ট এটনা ৷ জাগ্ৰত আগ্নেয়গিরিকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায় –সবিরাম ও অবিরাম আগ্নেয়গিরি৷ যেসকল জাগ্ৰত আগ্নেয়গিরিতে অবিরামভাবে লাভা নিৰ্গত হয়ে থাকে তাকে অবিরাম আগ্নেয়গিরি ও যেসকল এটা নিৰ্দিষ্ট সময়ের অন্তরালে ধোঁয়া,ছাই, গ্যাস বের হয়ে আসে সেসকল আগ্নেয়গিরিকে অবিরাম আগ্নেয়গিরি বলা হয়৷ ইটালীর ষ্ট্ৰম্বলী আগ্নেয়গিরি এ ধরনের আগ্নেয়গিরি ৷

২. সুপ্ত (Dorment) – যেসকল আগ্নেয়গিরির আগে উদগীরণ হয়েছিল,কিন্তু বৰ্তমানে সক্ৰিয় অবস্থায় নাই ,কিন্তু যেকোন সময় উদগীরণ হবার সম্ভাবনা আছে,সেসব আগ্নেয়গিরিকে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি বলে৷ যেমন – জাপানের ফুজিয়ামা ৷

৩. লুপ্ত (Extinct)- যেসসব আগ্নেয়গিরি কোন এক সময় জাগ্ৰত ছিল কিন্তু আগামীতে বা ভবিষ্যতে এর অগ্ন্যুৎপাত হবার কোনো সম্ভাবনা নাই,সেসকল আগ্নেয়গিরিকে লুপ্ত আগ্নেয়গিরি বলা হয়৷ যেমন – আফ্ৰিকার কিলিমাঞ্জারো ৷ কখনো কখনো লুপ্ত ও সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মুখে পানি জমা হরে একটা হ্ৰদের সৃষ্টি হয়৷ একে ধরণের হ্ৰদকে আগ্নেয়গিরি হ্ৰদ বলে৷

এছাড়া রয়েছে,

শিল্ড আগ্নেয়গিরি

গম্বুজ আকৃতির শিল্ড আগ্নেয়গিরি গুলোর তলদেশ চওড়া ঢাল সামান্য আকারে বৃহৎ।  তরল লাভা ভেন্ট দিয়ে এই আগ্নেয়গিরি  সম্ভৃদ্ধ থাকে।

স্ট্রাটো আগ্নেয়গিরি

জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ভস্ম ও লাভার সমন্বয়ে স্তরসমূহ দ্বারা এ জাতীয় আগ্নেয়গিরি গঠিত হয়। তরল লাভা আর পাথরের সমন্বয়ে কয়েক স্তরে এই আগ্নেয়গিরি গঠন হয়।

সিন্ডার আগ্নেয়গিরি

আকারে ছোট আগ্নেয়গিরিগুলোকে সিন্ডার আগ্নেয়গিরি বলে। এই আগ্নেয়গিরিতে কোন আনুভূমিক কোন লাভার স্তর থাকে না।  এই আগ্নেয়গিরিগুলোর গড় আকৃতি প্রায় ৮০০ মিটার চওড়া তল বিশিষ্ট এবং উচ্চতা হয় প্রায়  ১০০ মিটারের মত।

এ ছাড়াও আমরা বেশ কিছু আগ্নেয়গিরির প্রকারভেদ দেখা যায় । এগুলো হলঃ

যৌগিক আগ্নেয়গিরি 

এরা পার্শ্বযুক্ত খাড়া এবং মোচাকৃতির হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের লাভা, ছাই ও পাথর উদগিরণ করে থাকে এবং এদের চূঁড়ায় বিশাল খাঁদ দেখা যায়।

ঢাল বিশিষ্ট আগ্নেয়গিরি 

এটি প্রশস্ত কিন্তু আলতোভাবে লেগে থাকা ঢাল বিশিষ্ট আগ্নেয়গিরি। এর লাভা উদগিরণের পর বেশি দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় না।

অঙ্গারের সমন্বয়ে গঠিত মোচাকৃতির আগ্নেয়গিরি

সাধারণত এটির উদগিরণ অল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। এবং চূঁড়ায় গোলাকৃতি খাঁদের সৃষ্টি করে।

গম্ভুজাকৃতির লাভাবিশিষ্ট আগ্নেয়গিরি

এর লাভা বেশ চটচটে ধরনের হয়। তাই বেশি দূর পর্যন্ত প্রবাহিত হয় না এবং চূঁড়ার দিকে গম্বুজের মতো জমে থাকে।

আগ্নেয়গিরি উৎপত্তির কারণ

আগ্নেয়গিরি কিভাবে তৈরি হয় তা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে দুটো জিনিস – পৃথিবীর অভ্যন্তরীন গঠন ও টেক্টোনিক প্লেট।

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন- পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন দেখলে জানা যায় যে এখানে মূলত তিনটি স্তর রয়েছে- ভূত্বক (crust), ভূ-আচ্ছাদন (mantle) আর বহিঃস্থ মজ্জা (core)। আগ্নেয়গিরি বুঝতে হলে আমাদের দরকার হবে এর মাঝামাঝি স্তরটি যার নাম ভূ-আচ্ছাদন বা ম্যান্টল। যদিও ভূ-আচ্ছাদন কঠিন অবস্থায় থাকে, তবে উচ্চ তাপমাত্রার ফলে এটি এক সময় বেশ নমনীয় হয় এবং প্রায় তরলের মতোই প্রবাহিত হতে পারে। এই তরল পদার্থটিকে বলা হয় ম্যাগমা যার মধ্যে রয়েছে সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম, অক্সিজেন, এলুমিনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ।

টেক্টোনিক প্লেট – সাধারণত পৃথিবীর কঠিন বহিরাবরণ কয়েকটি অংশে বিভক্ত থাকে। এদেরই টেক্টোনিক প্লেট বলে। টেক্টোনিক প্লেটগুলো ম্যাগমার উপর ভেসে থাকে এবং প্লেটগুলো চলাচল করতে সক্ষম। এই প্লেটের চলাচলের ফলেই ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়। ওই প্লেট ক্রমাগত খুব আস্তে আস্তে চলাচল করে, কখনও একে অপরের কাছে বা কখনও দূরে যায়।

আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি- এবার দুটো টেক্টোনিক প্লেট যখন ভাসতে ভাসতে ধাক্কা খেয়ে একটা আরেকটার ওপরে উঠে যায়, তখন খুব জোরে চাপ পড়ার ফলে ও তাপ সৃষ্টি হওয়ায় সেই ম্যাগমা নামক তরল পদার্থ পৃথিবীর বুক চিরে বাইরে বেরিয়ে আসে। ম্যাগমা যখন বেরিয়ে আসে তখন তার নাম হয় লাভা। তারপর অনেক লাভা উদ্গীরণ হওয়ার ফলে তৈরি হয় আগ্নেয়গিরি। যেখান থেকে আগ্নেয়গিরি বের হয় তাকে দেখতে পাহাড়ের মত। আসলে লাভা বের হতে হতে পরে তা ঠাণ্ডা হয়ে পাথরের মত শক্ত হয়ে গেলে এটা পাহাড়ের মত দেখায়।

আগ্নেয়গিরি উৎপত্তির অন্যান্য কারণগুলো হলোঃ

  • ভূ-পৃষ্ঠের যতই অভ্যন্তর ভাগে যাওয়া যায় উত্তাপের মাত্ৰা বেড়ে যায়৷ যদিও ভূগৰ্ভের উপাদানসমূহ গলিত অবস্থায় আছে৷ কিন্তু পৃথিবীর উপরিভাগের শিলাস্তরসমূহের প্ৰচণ্ড চাপে এই উপাদানসমূহ গলিত হলেও স্থিতিশীল অবস্থাতে আছে৷ কোন কারণে এই চাপের পরিমাণ কমে গলে পৃথিবীর অভ্যন্তরের পদাৰ্থসমূহের স্থিতিস্থাপক অবস্থার পরিবৰ্তন হতে পারে৷ এর ফলে এই পদাৰ্থের ঐ তরল পরে কোনো ভঙ্গুর স্থান,ভিতর বা কোনো দুৰ্বল স্তরের মাঝে বাহির হয়ে আসলে আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয় ৷
  • আগ্নেয়গিরির উৎপত্তির আরো একটা কারণ হচ্ছে ভূগৰ্ভত থাকা জলীয় বাষ্প ও অন্যান্য বাষ্পের প্ৰচণ্ড চাপ৷ পৃথিবীর কোনো ভিতরের বা মাঝের ভূগৰ্ভতলে পানীসমূহ গলে ভূগৰ্ভের উত্তাপে সেই পানী বাষ্পে পরিণত হয় ও আয়তন বাড়ে৷ এভাবে আয়তন বাড়ার ফলে অভ্যন্তর ভাগে প্ৰচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়৷ ফলে গলিত পদাৰ্থসমূহের জলীয় বাষ্প ও অন্যান্য বাষ্প চাপের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উপরের উঠে আসে ৷
  • তেজষ্ক্ৰিয় উপাদান যেমন – রেডিয়াম,ইউরেনিয়াম এদের অবিরাম তাপ বিকিরণের ফলে ভূগৰ্ভের উত্তাপ বাড়ে ও ইহার বিভিন্ন উপাদানসমূহ তরল হলে আয়তন বাড়ে৷ তার ফলে কোনো সুড়ঙ্গ বা ফাঁটল দিয়ে এই উত্তপ্ত পদাৰ্থসমূহ উপরে উঠে আসলে আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করতে পারে৷
  • ভূগৰ্ভের কোথাও কিংবা রাসায়নিক কারণে বাষ্পের সৃষ্টি হলে সেই বাষ্প পৃথিবীর উপরি ভাগের দুৰ্বল অংশের চাপের কারণে আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করতে পারে৷

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের প্রকারভেদ

আগ্নেয়গিরি থেকে ভূগর্ভস্থ পদার্থের নির্গমনকে বলা হয় অগ্ন্যুৎপাত। গবেষকগন আগ্নেয়গিরি অগ্নুৎপাত এর সময় নির্গত লাভা, ছাই, গ্যাস এর ধরণের উপর ভিত্তি করে  অগ্নুৎপাতকে কয়েক প্রকারে ভাগ করেছেন। এগুলোর নামকরণের ক্ষেত্রে সাধারণত পূর্বের কোন অগ্নেয়গিরির নাম অনুসরণ করা হয়েছে। ঐ আগ্নেয়গিরিতে  এ ধরনের অগ্নুৎপাত সংঘটিত হয়েছে বলেই এর নাম অনুসরন করা হয়েছে। । কিছু কিছু অগ্নেয়গিরিতে শুধুমাত্র একধরনের অগ্নুৎপাত সংঘটিত হয় পক্ষান্তরে কিছু কিছুতে সময়ের ক্রমানুসারে একাধিক ধরনের অগ্নুৎপাত সংঘটিত হয়। আগ্নেয়গিরি অগ্নুৎপাতকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। ম্যাগমাটিক অগ্নুৎপাত, প্রিটোম্যাগমেটিক অগ্নুৎপাত ও প্রিয়াটিক অগ্নুৎপাত।

ম্যাগমাটিক অগ্নুৎপাত

ভূগর্ভস্থ গ্যাসের চাপ কমে গ্যাস নির্গত হওয়ার মাধ্যমে ম্যাগমাটিক অগ্নুৎপাত হয়। এ সময় সংকোচিত গ্যাস বিস্ফোরনের মাধ্যমে ম্যাগমাটিক অগ্নুৎপাতে গলিত লাভা উদগীরন করে। ম্যাগমাটিক অগ্নুৎপাতের অপেক্ষাকৃত ছোট উদগীরন এর প্রবলতা হয় প্রায় ৩০ কিঃমিঃ উচু হয়ে থাকে। এই উচ্চতা  খ্রিস্টপূর্ব ৭৯ সালে ইটালির  পম্পেই নগরী ধংসকারী মাউন্ট ভিসুভিয়াস এর উদগীরনের উচ্চতা থেকে বেশি। মাউন্ট ভিসুভিয়াস, মাউন্ট ইতনা,  মায়ন ভলকানো,মাউন্ট মিহারা  ইত্যাদিতে এই ধরনের অগ্নুৎপাত  দেখা যায়।

প্রিটোম্যাগমেটিক অগ্নুৎপাত

যে অগ্নুৎপাত পানি ও লাভার মধ্যকার পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় তাকে প্রিটোম্যাগমেটিক অগ্নুৎপাত বলে। তাপীয় সংকোচনের ফলে প্রিটোম্যাগমাটিক অগ্নুৎপাত হয়। মাউন্ট তারাওয়েরাতে প্রিটম্যাগমাটিক অগ্নুৎপাত  হয়।

প্রিয়াটিক অগ্নুৎপাত

বাষ্প সম্প্রসারণের মাধ্যমে যে অগ্নুৎপাত সংঘঠিত হয় তাকে বলা হয় প্রিয়াটিক অগ্নুৎপাত ।  যখন ঠান্ডা বাতাস অথবা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তপ্ত শিলার সংস্পর্শে আসে তখন শিলা অত্যধিক উত্তপ্ত হয়ে বাষ্পে পরিনত হয় এবং পাশ্ববর্তি শিলাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে পানি, আগ্নেয় গোলা, আগ্নেয় শিলা আকারে উদগীরন  করে।বাষ্পীয় উদগিরনের সময় নির্গত ধাতব কনার ফলে প্রিয়াটিক অগ্নুৎপাত হয়। মাউন্ট হেলেন্,  তাল ভলকানো,লা সোপরিয়ের, সোপরিয়েরি হিলস ইত্যাদিতে প্রিয়াটিক অগ্নুৎপাত হয়।

রিং অফ ফায়ার বা অগ্নিবলয়

তামু ম্যাসিফ (Tamu Massif ) হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি যেটি  জাপানের উপকূলীয় এলাকার কাছে সমুদ্রগর্ভে অবস্থিত , এই অগ্নেয়গিরির বিস্তৃতি প্রায় এক লাখ ২০ হাজার বর্গমাইলের মতো । যার  আনুমানিক বয়স হল প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি বছর। এ দিকে ফিলিপাইনে একটি আগ্নেয়গিরি ফুঁসে ওঠার কারণে সেই স্থান পরিত্যাগ করেছে অনেক মানুষ। পৃথিবীর উপরিভাগ যে ভাসমান প্লেটগুলোর ওপর আছে, সেগুলোকে ডাকা হয় টেকটনিক প্লেট বলে। আর এই প্লেটগুলোর সংযোগস্থলগুলো মিলে গঠিত হয়েছে বলয়।  পৃথিবীর  ৯০ শতাংশ জীবন্ত আগ্নেয়গিরির অবস্থান দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে। এ কারনে এ এলাকাকে বলা হয় রিং অব ফায়ার বা অগ্নিবলয়।

এই বলয় ঘিরেই সংগঠিত হয় বিশ্বের বেশিরভাগ ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির উদগীরনের ঘটনা। সাম্প্রতি  বেশ কিছু  বড় অগ্নুৎপাত ও ভূমিকম্পের পর বিজ্ঞানীরা  প্রশ্ন তুলেছেন যে, এই রিং অব ফায়ার কি বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে? এবং এটার প্রভাবে আগামীতে আরও বড় ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে কি ?

ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে চিলির সমুদ্রকূল পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার জুড়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ সক্রিয় এবং সুপ্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। আর এসব আগ্নেয়গিরির কাছাকাছিই নিয়মিত ভূমিকম্পের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

অগ্ন্যুৎপাতের ফলাফল

অগ্নুৎপাতের ফলে মালভূমির সৃষ্টি হয়, দ্বীপের সৃষ্টি হয়, ভূপৃষ্টের কোনো অংশ ধ্বসে  গভীর গহ্বরের সৃষ্টি  হতে পারে, আগ্নেয় হ্রদের সৃষ্টি হয়,লাভা উদগিরনের ফলে পর্বতের সৃষ্টি হতে পারে , লাভা সঞ্চিত হতে হতে বিস্তৃত এলাকা নিন্ম সমভূমিতে পরিনত হতে পারে,  গ্রাম,নগর,কৃষিক্ষেত্র  ধবংস হয়ে যেতে পারে অনেক সময়  ভূমির উর্বতা বৃদ্ধি  পায়, ভু অভ্যন্তরে থাকা নানা খনিজ পদার্থ নির্গত হতে পারে।

বিশ্বের কয়েকটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি

  • ইতালির ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি – সর্বশেষ অগ্নুৎপাত ১৯৪৪ সালে।
  • জাপানের সাকুরাজিমা আগ্নেয়গিরি- ছয় বছর ধরে নিয়মিত অগ্ন্যুৎপাত ঘটছে;
  • কঙ্গোর নিইরাগঙ্গো আগ্নেয়গিরি- ২০০২ সালে শেষ অগ্নুৎপাত ঘটে।
  • হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মউনা লোওয়া আগ্নেয়গিরি – এটি থেকে প্রায় সারা বছরই লাভার উদগীরণ হয়।
  • গুয়াতেমালার সান্তা মারিয়া আগ্নেয়গিরি – ১৯০২ সালে সর্বশেষ অগ্নুৎপাত হয়।
Facebook Comments

Related Articles

Back to top button