মহাকাশ

মঙ্গলগ্রহে পরবর্তী মিশন “মার্স ২০২০-রোভার পারসিভ্যারান্স”

19 / 100

“মঙ্গল মিশন রোভার পারসিভারেন্স” বর্তমানে মার্কিন স্পেস সংস্থা ‘নাসার’ সর্বাধিক গুরুত্বের বিষয় যা আগামী জুলাই ২০২০ থেকে আগস্ট ২০২০ এর মাঝামাঝি কোন এক সময় লঞ্চ করা হবে বলে জানিয়েছেন নাসা কর্তৃপক্ষ।

কেন এই সময়ে লঞ্চ করা জরুরী?

প্রায় ২৪ কোটি মার্কিন ডলার বাজেটের এই মিশনটি এখনই লঞ্চ করার অন্যতম কারন হচ্ছে, এ মিশনের Launch Window অত্যন্ত কম। লঞ্চ উইন্ডো হচ্ছে কোন স্পেস শাটল উৎক্ষেপণের শুরু থেকে তা মহাশূন্যের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছানোর মধ্যবর্তি সময়। ভূ-পর্যবেক্ষণের জন্য যেসব রকেট পাঠানো হয় তার নির্দিষ্ট কোন লঞ্চ উইন্ডো হয় না, অর্থাৎ দিনের যে কোন সময় (সাধারণত যখন লঞ্চ সাইট কাঙ্খিত কক্ষপথের সাথে সমান্তরাল থাকে তখনই) মিশন লঞ্চ করা যায়। কিন্তু পৃথিবী থেকে ২০ কোটি কিলোমিটার দূরের মঙ্গলে রোভার পাঠানোর মত মিশনের লঞ্চ উইন্ডোর একেকটি সেকেন্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

280px Animation of InSight trajectory
লঞ্চিং উইন্ডোর ধারণা

মার্স রোভার ২০২০ মিশনটি সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য সুনির্দিষ্ট যে সময়টি সবথেকে বেশি উপযুক্ত তা খুব অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা অতিবাহিত করব। কেননা ঐ সময় মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থান করবে এবং পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপিত রকেট/স্পেস শাটল সহজেই মঙ্গলে পাঠানো সম্ভব হবে। ১৭ এপ্রিল থেকে ০৫ আগস্টের মধ্যে যদি এ মিশন লঞ্চ করা না হয় কিংবা কোন কারনে ব্যর্থ হয়ে যায় তবে আমাদেরকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে গুনে গুনে আরো দুটি বছর। এ কারনে কভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে অন্যান্য সব স্পেস সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে নাসার “মার্স রোভার ২০২০ মিশন”। পুরো দমে নেয়া হচ্ছে প্রস্তুতি।

perseverance
রোভার পারসিভ্যারান্স যার নামের অর্থ অধ্যাবসায়

মার্স ২০২০ মিশনের জন্য সুসজ্জিত রোভারটির নাম দেয়া হয়েছে ‘পারসিভ্যারান্স’, যার অর্থ ‘অধ্যাবসায়’। গত ফেব্রুয়ারিতে রোভারটি কেনিডি স্পেস সেন্টারে পৌছে চুড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। নাসা মার্স এক্সপ্লোরেশন প্রোগ্রামের পরিচালক জিম ওয়াটজিন জানিয়েছেন, ৮০ জন সদস্যের একটি দল ফ্লোরিডার কেনিডি স্পেস সেন্টারে চুড়ান্ত সংযোজন হিসেবে রোভারের সঙ্গে একটি ড্রোন হেলিকপ্টার সংযুক্ত করছে যা মঙ্গলে ল্যান্ডিংয়ের পরপরই পারসিভ্যারান্স (রোভার) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং ৮০ জন সদস্যের আরো একটি দল কাজ করছে ফ্লোরিডা থেকে ২৭০৫ মাইল দূরে ক্যালিফোর্নিয়াতে নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরিতে চুড়ান্ত হার্ডওয়্যার সেটাপ প্রজেক্টে। যেহেতু পুরো সিস্টেম উৎক্ষেপণ করা হবে কেনিডি স্পেস সেন্টার থেকেই সেহেতু কভিড-১৯ মহামারির মধ্য দিয়ে ক্যালিফর্নিয়া থেকে ফ্লোরিডায় তাবড় তাবড় যন্ত্রাংশ নিয়ে নিরাপদ ভ্রমণ আরো একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। তবে মিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে কেনিডি স্পেস সেন্টারে একটি বড়সড় ওয়ার্কস্পেসের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে সংশ্লিষ্টগণ নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে পারেন। হাতে অবশিষ্ট স্বল্প সময়ের মধ্যে শিডিউল অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করার জন্য সকলেই পরিশ্রম করে চলেছে।

এ মিশনের লক্ষ্য কি?

মার্স রোভার ২০২০ মিশনের মূল লক্ষ্য হল মঙ্গলের একটি অঞ্চলের পুরোনো বা প্রাচীন পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করা। এ উদ্দেশ্যে পারসিভ্যারান্স রোভারটি মঙ্গলের বেশ খানিকটা মাটি এবং মার্সিয়ান পাথর বা শিলার নমুনা সংগ্রহ করবে, সেইসঙ্গে তুলবে প্রচুর ছবি। এ বছর ১৭ এপ্রিল থেকে ০৫ আগস্টের মধ্যে স্পেস শাটল লঞ্চ সফল হলে এই গল্পের নায়ক দ্য পারসিভ্যারান্স রোভারটি মঙ্গলের ‘জাজিরো ক্রেটার’ নামক অঞ্চলে গিয়ে ল্যান্ড করবে ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নাগাদ। এরপর সে পালন করতে থাকবে তার দায়িত্ব এবং মঙ্গল গ্রহটি আমাদের রোভারটিকে বয়ে নিয়ে দীর্ঘ দুটি বছর ধরে (পৃথিবীর সাপেক্ষে) সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করার পর ঠিক পূর্বের অবস্থানে ফিরে এলেই পারসিভ্যারান্স ধরবে ফিরতি পথ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তার কয়েক মাসের মধ্যেই পারসিভ্যারান্স আসবে ফিরে, এই ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বসুন্ধরায়।

মঙ্গলের পাথর দিয়ে আমরা কি করব?

মঙ্গলের মাটি, পাথর, শিলাখন্ডের নমুনা সফলভাবে পৃথিবীতে পৌছে গেলে তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাখা হবে কোয়ারান্টাইনে। এস্ট্রোনউট ও ফিজিসিস্টদের পর্ব শেষ করে এবার দায়িত্ব কেমিস্ট, বোটানিস্ট ও জুওলজিস্টদের ঘাড়ে। তারা নমুনাগুলোকে পরীক্ষা করবেন যাতে সঙ্গে করে অজানা কোন এলিয়েন জীবাণু চলে এলে তা প্রতিরোধ করা যায়। এরপর শুরু হবে মূল গবেষণা। পরীক্ষা করা হবে এসব নমুনার রাসায়নিক, খনিজ, ভৌত ও জৈব বৈশিষ্ট্যসমূহ। এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পারব মঙ্গলের প্রাচীন পরিবেশ কেমন ছিল এবং একই সঙ্গে এসব উপাদান ভবিষ্যতে মঙ্গলে পা রাখতে চলা মানুষের জন্য ক্ষতিকর কি না তা-ও বোঝা যাবে।

স্কাই ক্রেন ল্যান্ডিং সিস্টেম
স্কাই ক্রেন ল্যান্ডিং সিস্টেম

পারসিভ্যারান্স রোভারটিতে মাউন্ট করা থাকবে স্পেশাল দুটো রোবটিক বাহু যার মাধ্যমে রোভারটি নমুনা সংগ্রহ করে জায়গামত সামলে রাখবে। থাকবে Mastcam-Z, SuperCam এর মত দুটো পাওয়ারফুল ক্যামেরা, যার একটি সংযুক্ত থাকবে সর্বপরিচিত ডিভাইস ‘মার্সকপ্টার’ নামক একটি ড্রোনের সঙ্গে যা ল্যান্ড করার পরপরই রোভার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ‘কিউরিসিটি’ রোভারের মত পারসিভ্যারান্স রোভারটির ক্ষেত্রেও ল্যান্ডিং ডিভাইস হিসেবে একই স্কাই ক্রেন ল্যান্ডিং সিস্টেম ব্যবহার করা হবে। স্কাই ক্রেন ল্যান্ডিং সিস্টেম হচ্ছে কোন গ্রহে নিরাপদভাবে রোভার ল্যান্ড করানোর জন্য ব্যবহৃত একটা যন্ত্র যা ক্রেনের মতই কাজ করে। নিচের ছবিটির মত। তবে এই ল্যান্ডিং সিস্টেমটি মঙ্গলের আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং অঞ্চলে ল্যান্ড করার ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করবে।

অধ্যবসায় রোভারের নিম্নলিখিত অংশগুলি রয়েছে:

  • বডিঃ একটি কাঠামো যা রোভারের “গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি” রক্ষা করবে
  • ব্রেইনঃ কম্পিউটার দ্বারা তথ্য প্রক্রিয়াকরণ
  • তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণঃ অভ্যন্তরীণ হিটারস, নিরোধকের একটি স্তর এবং আরও অনেক কিছু
  • ঘাড় ও মাথাঃ ক্যামেরাগুলির জন্য রোভারকে মানব-স্কেল দেখার একটি ম্যাস্ট
  • চোখ এবং কানঃ ক্যামেরা এবং যন্ত্রগুলি যা রোভারকে তার পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য দেয়
  • বাহু এবং “হাত”: তার নাগালের প্রসার বাড়ানোর এবং অধ্যয়নের জন্য শিলা নমুনা সংগ্রহ করার একটি উপায়
  • চাকা এবং পা: গতিশীলতার জন্য
  • বৈদ্যুতিক শক্তি: ব্যাটারি এবং শক্তি
  • যোগাযোগ: “কথা বলা” এবং “শ্রবণ” এর জন্য অ্যান্টেনা

এক কথায় জেনে নিই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-

  • মিশনের নাম- মার্স ২০২০ (Mars 2020)
  • রোভারের নাম- পারসিভ্যারান্স (Perseverance) যার অর্থ ‘অধ্যাবসায়’
  • মূল লক্ষ্য- মঙ্গলের প্রাচীন পরিবেশ নিয়ে গবেষণা এবং কিছু মার্সিয়ান শিলার নমুনা সংগ্রহ করা।
  • লঞ্চিং উইন্ডো- ১৭ জুলাই ২০২০ – ০৫ আগস্ট ২০২০
  • লঞ্চিং লোকেশন- ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল এয়ার ফোর্স স্টেশন
  • মঙ্গলে ল্যান্ড করবে- ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১
  • ল্যান্ডিং সাইট- মঙ্গলের জাজিরো ক্রেটার অঞ্চল
  • মিশন স্থিতিকাল- পৃথিবীর সাপেক্ষে ৬৮৭ দিন (এক মার্সিয়ান বছর)
  • টেক ডেমো- মার্স হেলিকপ্টার, যা পারসিভ্যারান্স রোভারের উপরে মাউন্ট করা থাকবে।

তথ্যসূত্রঃ মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-নাসা

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button