মহাকাশ

এলিসা কার্সেন: মঙ্গলে অবতরণকারী প্রথম মানবী হতে যাচ্ছে যে

বেশিরভাগ কার্টুন নিছকই বাচ্চাদের মনের খোরাক জোগানো ও বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়। শিশুরা তা দেখে মজাও পায়। কার্টুন থেকে আমরা কতটুকু শিক্ষা অর্জন করি এই প্রশ্নটা যদিও আগে তেমন একটা ওঠেনি, কেননা কার্টুন কেবলই ছেলেভোলানো একটি মাধ্যম হিসেবে ধরা হত; তবে এখন এই প্রশ্নটা আসে।

বর্তমান সময়ের অভিভাবকরা এই বিষয়ে বেশ সচেতন যে, তাদের বাচ্চারা কী ধরনের কার্টুন দেখছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, একটা ভালো কার্টুন যেমন বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে সাহায্য করে, তেমনই একটা খারাপ কার্টুন বাচ্চাদের মূল্যবোধের জায়গাটা করে দিতে পারে শূন্য। তাই বাচ্চাদের সুস্থ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে কার্টুনের ভূমিকা অনস্বীকার্য; এই বিষয়টা হয়তো এলিসা কারসেনের বাবা-মা বেশ ভালোভাবেই জানতেন।

নিচের ভিডিওতে ব্যাকইয়ার্ডিগান্স কার্টুনের ‘মিশন টু মার্স’ পর্বের লিংক দেওয়া হলো-

প্রত্যেক বাবা-মাই চান তাদের সন্তান বড় হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াক, উড়তে শিখুক… আর সেই চাওয়া বাস্তবায়ন করতেই ছোট থেকে শিশুদের সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়াটা খুবই জরুরি। এলিসা কার্সেনের বাবাও এই চাওয়া ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তা-ই তো অন্য গ্রহে উড়াল দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে মেয়েকে বাঁধা দেননি কখনও, বরং মেয়ে একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে জেনেও, বুকে পাথর বেঁধে মেয়েকে সাহস দিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্ন দেখার।

ছোট্ট এলিসার সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ ঘটিয়ে এমন স্বপ্নের বীজ বুনেছিলো নিকোলোডিয়ান এনিমেটেড টিভি শো, ব্যাকইয়ার্ডিগান্স। ছোটবেলায় এলিসার পছন্দের কার্টুন ছিল ব্যাকইয়ার্ডিগান্স; তার বয়স যখন তিন বছর তখন এই কার্টুন শো-এর একটি পর্বে দেখানো হয় চার প্রাণী-বন্ধু সুদূর একটা মঙ্গলগ্রহে বেড়াতে গেছে; দেখে বেশ অভিভূত হয় এলিসা। তার কৌতূহলী মনে কিছু প্রশ্ন জাগে; বাবা বার্ট কার্সেনের কাছে জানতে চায় সেসকল প্রশ্নের উত্তর। বার্ট এলিসাকে জানান, “এখনও পর্যন্ত মানুষের পক্ষে মঙ্গলগ্রহে পা রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তবে তার প্রজন্মে এটা সম্ভব হতে পারে।”

বাবার কথা শুনে মঙ্গলে যাওয়ার ইচ্ছাটা পুরোপুরি জেগে বসে এলিসার ছোট্ট মনে। মঙ্গলে যাওয়ার ইচ্ছাটা এলিসার মনে এতই প্রবলভাবে গেঁথে যায় যে, তার বিশ্বাস হতে শুরু হয়, পৃথিবী না; মঙ্গলগ্রহই তার বাসা। সে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে যেন সে প্রথমে মঙ্গলে পা রেখে সেটাকে আরও কিছু মানুষের বসবাস উপযোগী করতে পারে।

২০০১ সালের ১০ মার্চ আমেরিকার লুইজিয়ানা রাজ্যের হ্যামন্ড শহরে জন্ম গ্রহণ করা এলিসা কার্সেন তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে নিজের সাথে এতটাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, ১২ বছর বয়সেই সে আমেরিকার ৯টি অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত নাসার ১৪টি নাসা ভিজিটস সেন্টার পরিদর্শন সম্পূর্ণ করে। এবং সেই বছর, ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে সে ডাক পায় ওয়াশিংটন ডিসির নাসা টিভির এমইআর ১০ প্যানেলে আগমনী মিশন মার্সের জন্য, যা এই পর্যন্ত তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করে এলিসা, কেননা এই প্যানেলের বাকি সদস্যের কেউ ছিলেন পিএইচডি ডিগ্রিধারী, আবার কেউ ছিলেন নভোচারী। পরবর্তীতে মঙ্গলে প্রথম মানব হিসেবে পা রাখার মিশনে নির্বাচিত সাতজন ব্যক্তির একজন হিসেবে একটি ডেনমার্ক কোম্পানির অগ্রদূত হিসেবে নির্বাচিত হয় সে। জেনে অবাক হবেন, এলিসা কার্সেনই একমাত্র ব্যক্তি যে কি না আমেরিকার প্রত্যেকটি নাসা ভিজিটর সেন্টার পরিদর্শন করে, যেটা নাসা পাসপোর্ট প্রোগ্রাম নামে পরিচিত।

এলিসার বয়স যখন ৭ বছর তখন থেকে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তার যাত্রা মূলত শুরু হয়। সালটা ছিল ২০০৮, এলিসা প্রথম কোনো স্পেস ক্যাম্প পরিদর্শন করে এবং সেটি ছিলো আমেরিকার স্পেস ক্যাম্প। পরবর্তীতে একে একে সে কানাডা এবং তুরস্কের স্পেস ক্যাম্প পরিদর্শন করে। এভাবে সে তার জীবনের প্রথম রেকর্ডটি তৈরি করে; কারণ ৩টি স্পেস ক্যাম্প পরিদর্শকের মধ্যে এলিসা কার্সেন হচ্ছে সর্বকনিষ্ঠ। শুধু তা-ই নয়, ২০১৬ সালে অ্যাডভান্সড পসম একাডেমির সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যাজুয়েট হিসেবেও ইতিহাসের পাতায় নাম লেখায় স্বপ্নবিলাসী এই ছোট্ট মেয়ে।

এলিসা কার্সেন ও তার বাবা বার্ট কার্সেন; coutesy: theadvertiser

মঙ্গলে যাওয়ার নেশা বুদ হয়ে থাকা মেয়েটি তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে দিন-রাত হাড় ভাঙা পরিশ্রম দিয়েই যাচ্ছে। এই কিশোর বয়সে সে পড়াশোনার পাশাপাশি একইসাথে ইংরেজি, ফ্রান্স, স্প্যানিশ ও চীন এই চারটি ভাষার শিক্ষা নিচ্ছে। স্বপ্নচারী হওয়ায় সমসাময়িকদের তুলনায় তাকে পরিশ্রম করতে হয় বহুগুণ। কিন্তু তাতে কোনো আপত্তি নেই এই ছোট্ট স্বপ্নকন্যার। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠলে মনে করে নেয়, “এই শিক্ষাগুলো তাকে স্বপ্নের চূড়ার দিকে ধাবিত করছে। এই পরিশ্রমগুলোই তার জীবনে এনে দেবে স্বপ্ন পূরণের আত্মতৃপ্তি।“ এবং সে এই কঠিন সময়গুলো নিয়ে মোটেই বিমর্ষ নয়, বরং তার বিশ্বাস সে বেশ ভালোভাবেই সবকিছু করে চলেছে। সে তার ট্রেনিং থেকে অনেক কিছু শিখছে যা তার জীবনে বিশেষভাবে কাজে লাগবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, অপরকে সাহায্য করার শিক্ষা।

এলিসা তার লক্ষ্যে পুরোপুরি মনোযোগী হলেও সে তো একজন সাধারণ কিশোরীই, তাই বাকিদের মতো তার মনেও তৈরি হয় নানা ধরনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। সে কখনও হতে চায় প্রধানমন্ত্রী, কখনও বা হতে চায় শিক্ষক; এবং আট-দশটা কিশোর-কিশোরীদের মতো সব ইচ্ছাই পূরণ করতে ইচ্ছা হয় তার। কিন্তু সে তো এই গ্রহের নয়! সে মঙ্গলের বাসিন্দা, এ কথা আমরা ভুলে গেলেও ছোট্ট এলিসা কখনই ভোলে না। তাই যখনই তার ইচ্ছা হয় বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী বা শিক্ষক হতে; সে ভেবে নেয়, “প্রথমে আমি আমার মঙ্গলে পাড়ি জমাবো, সেখানে গাছ লাগিয়ে জীবনের সন্ধান করবো; যদি ফিরে আসি তবে এক এক করে বাকি ইচ্ছাগুলো করবো।

ছোট্ট এলিসার মনে মঙ্গলে পাড়ি জমানোর স্ফুলিঙ্গটা যদিও একটা অ্যানিমেটেড টিভি শো তৈরি করেছে, কিন্তু এর পালে হাওয়া দিয়েছে বিভিন্ন ধরনের বই, ভিডিও যেগুলো থেকে সে নভোযান, রকেট, মঙ্গলগ্রহের ব্যাপারে তথ্য পেত। এবং তার মনের এই স্ফুলিঙ্গে আগুন জ্বালাতে সাহায্য করে নভোচারী স্যান্ড্রা ম্যানগাস যার সাথে তার দেখা হয়েছিল একটি স্যালি রাইড ডে ক্যাম্পে। তখন এলিসার বয়স ছিলো মাত্র ৯ বছর বয়স। স্যান্ড্রো ম্যানগাসের সাথে দেখা করে সে জানতে চায়, ম্যানগ্যাসের নভোচারীর হওয়ার স্বপ্ন দেখা কোথা থেকে শুরু। ম্যানগাস বলেন, ৯ বছর বয়সে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি একজন নভোচারী হবেন এবং তখন থেকেই নিজেকে তৈরি করেছেন। এলিসা ম্যানগ্যাসের কাছ থেকে আরও জানতে পারে, কীভাবে তিনি তার ক্যারিয়ারের দিকে এগিয়েছেন। এরপর আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠে এলিসা কার্সেন।

ট্রেনিং চলাকালে এলিসা; courtesy: wetpaintlife

ইতিমধ্যে এলিসা কিছু নভোচারীর সাথে অনেকগুলো কৃত্রিম মিশনে কাজ করে ফেলেছেন। যেখানে তার কল সাইন ‘ব্লুবেরি’। তাই সে ‘এলিসা কার্সেন’ নামের পাশাপাশি ‘ব্লুবেরি’ নামেও বেশ পরিচিত। এলিসা কার্সেনের সাফল্যের ঝুলিতে আরও আছে রকেটও। হ্যাঁ, সে কিছু রকেটও তৈরি করেছে।

এলিসা মঙ্গলগ্রহ বা রেড প্ল্যানেটে পাড়ি জমাবে ২০৩০ সালে, ২৯ বছর বয়সে। এর পূর্বে সে প্রেম বা বৈবাহিক কোনো ধরনের সম্পর্কে জড়ানো অথবা সন্তান জন্ম দিতে অনুমতি পাবে না।

মঙ্গলগ্রহে পৌঁছাতে এলিসার সময় লাগবে ৬ মাস, এবং সেখান থেকে ফিরে আসতে সময় লাগবে ৯ মাস। এর আগে কোনো নভোচারী এত সময় সাপেক্ষ মিশনে যাননি। কিন্তু ব্লুবেরি এই বিষয় নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়।

স্বপ্নদ্রষ্টা এলিসা কার্সেন; courtesy: dailymail.co.uk

এলিসা তার জীবন নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট এবং সে চায় শিশুরা যেন তাকে দেখে প্রেরণা অর্জন করে; বিশেষত মেয়েরা। কেননা স্বাভাবিক জীবনের খোলস থেকে মেয়েদের বেরিয়ে আসতে কখনও কখনও অনুপ্রেরণার বিশেষ প্রয়োজন হয়।

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button