নারীরা কেন পুরুষের চেয়ে দীর্ঘায়ু হন, সেই রহস্যভেদ করে ফেললেন বিজ্ঞানীরা
গবেষকরা ভেড়া থেকে শুরু করে হাতি পর্যন্ত ১০১ টি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং ৬০% এরও বেশি প্রজাতির গবেষণায় দেখেছেন যে নারীরা পুরুষের তুলনায় গড়ে ১৮% বেশি বেঁচে থাকেন। মনুষ্য প্রজাতিতে নারীরা পুরুষের তুলনায় প্রায় ৭.৮% বেশি বাঁচেন।
কেন নারীরা পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁচেন, তার উত্তর এতদিন বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল না। অতীতে অনুমান করা হত নারীরা তাঁদের জীবনযাত্রার জন্যই দীর্ঘায়ু হন। এই রহস্যও কিছুদিন আগে ভেদ করেছে বিজ্ঞান। ইউনিভার্সিটি লিয়ন ১-এর বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে এবং জার্নাল ‘প্রসিডিংস অফ ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রে, বিজ্ঞানীরা বলেছেন, নারীদের জিনেই লুকিয়ে আছে দীর্ঘায়ু হওয়ার উত্তর।
সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীর পুরুষ হয়ে জন্মানো নির্ভর করে, প্রতিকোষে থাকা এক জোড়া যৌন ক্রোমোজোমের ওপর। স্ত্রীদের প্রতি কোষে থাকে দুটো X বা X X ক্রোমোজোম। পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য দরকারি জিনগুলি থাকে এই X ক্রোমোজোমগুলির ভেতর। এছাড়াও X ক্রোমোজোমের ভেতরে থাকে মস্তিস্কের কাজ কারবার দেখার জিন।
অন্যদিকে পুরুষদের প্রতি কোষে থাকে একটি X ক্রোমোজোম, পুরুষদের অপর ক্রোমোজোমটি হল Y। পুরুষের এই Y ক্রোমোজোমটির ভেতরে থাকে, পুরুষের বিভিন্ন লক্ষণের জিন। যেমন পুরুষাঙ্গ, শুক্রাশয়, শক্ত পেশিবহুল চেহারা, দাড়ি গোঁফ, সারা দেহে লোমের আধিক্য, গলার মোটা স্বর ইত্যাদি বৈশ্যিষ্টের জিন।
নারীদের আয়ু কেন বেশি তা জানতে একটি বিস্ময়কর পরীক্ষা করেছিলেন জীববিজ্ঞানীরা
নারীদের দীর্ঘ জীবনের সঙ্গে ক্রোমোজোমের সম্পর্ক জানতে, ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। প্রকৃতিগতভাবে স্ত্রী ইঁদুরের মধ্যে XX ও পুরুষ ইঁদুরের মধ্যে XY লিঙ্গ নির্ধারণকারী ক্রোমোজোম থাকে। পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানীরা কিছু ইঁদুরের দেহে লিঙ্গ নির্ধারণকারী ক্রোমোজোম সজ্জা পালটে দিয়েছিলেন। তাঁরা কিছু স্ত্রী ইঁদুরের ডিম্বাশয়ে পুরুষদের XY ক্রোমোজোম ও কিছু পুরুষ ইঁদুরের শুক্রাশয়ে নারীদের XX ক্রোমোজোম দুটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
অর্থাৎ কিছু নারী ইঁদুরে গিয়েছিল পুরুষ ইঁদুরের ক্রোমোজোম এবং কিছু পুরুষ ইঁদুরে গিয়েছিল নারী ইঁদুরের ক্রোমোজোম। এর ফলে পরীক্ষাটির জন্য বিজ্ঞানীরা পেয়ে গিয়েছিলেন চার ধরনের ক্রোমোজোম যুক্ত ইঁদুর। স্বাভাবিক পুরুষ ইঁদুর (XY) , স্বাভাবিক স্ত্রী ইঁদুর(XX), ক্রোমোজোম পালটে দেওয়া পুরুষ ইঁদুর (XX), ক্রোমোজোম পালটে দেওয়া স্ত্রী ইঁদুর(XY)।
সাধারণত ইঁদুরের জীবন কাল ২১ মাসের হয়। ল্যাবরেটরিতে রাখা চার ধরনের ইঁদুরদের সবার বয়স ২১ মাস হওয়ার পর, বিজ্ঞানীরা ইঁদুরদের মধ্যে দীর্ঘায়ু হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হতে দেখেছিলেন।
● দীর্ঘায়ু হওয়ার প্রতিযোগিতায় চতুর্থ হয়ে সবার আগে মারা গিয়েছিল ক্রোমোজোম পালটে দেওয়া স্ত্রী ইঁদুরগুলি, যাদের ডিম্বাশয়ে পুরুষ ইঁদুরের মত XY ক্রোমোজোম ছিল।
● দীর্ঘায়ু হওয়ার প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছিল স্বাভাবিক পুরুষ ইঁদুর, যার শুক্রাশয়ে XY ক্রোমোজোম ছিল।
● দীর্ঘায়ু হওয়ার প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছিল ক্রোমোজোম পালটে দেওয়া পুরুষ ইঁদুরগুলি, যার শুক্রাশয়ে নারী ইঁদুরের মত XX ক্রোমোজোম ছিল।
● দীর্ঘায়ু হওয়ার প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে, সবচেয়ে বেশিদিন বেঁচে ছিল স্বাভাবিক স্ত্রী ইঁদুরগুলি, যাদের ডিম্বাশয়ে জন্মগতভাবেই XX ক্রোমোজোম ছিল।
বিজ্ঞানীরা এই পরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন
পরীক্ষাটির পর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, স্ত্রী ইঁদুরের দ্বিতীয় X ক্রোমোজোমটিতেই আছে সেই জিন। যা স্ত্রী ইঁদুরকে দীর্ঘায়ু হতে সাহায্য করে। এই দ্বিতীয় X ক্রোমোজোমটি পুরুষদের না থাকায় পুরুষরা নারীদের আগেই পৃথিবী ছাড়ে। বিশ্বখ্যাত নিউরোলজিস্ট ও গবেষক দলটির প্রধান, ডেনা ডুবাল বলেছেন, “ আমাদের গবেষণা বলছে, XX ক্রোমোজোম যুক্ত স্ত্রী ইঁদুরদের ডিম্বাশয়ে উৎপন্ন হওয়া স্ত্রী হরমোনগুলি স্ত্রী ইঁদুরদের দীর্ঘায়ু হতে সাহায্য করে।”
বিজ্ঞানী ডুবাল জানিয়েছেন,” আমাদের অনুমান, মানুষের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ শরীরের সব কিছু যখন ভুল ভাবে চলতে শুরু করে, তখন দ্বিতীয় X ক্রোমোজোমটি মানব নারীদের জীবন একই ছন্দে চালাতে থাকে।“ তাহলে পুরুষের শরীরে থাকা Y ক্রোমোজোমটি কি পুরুষদের দীর্ঘায়ু হওয়ার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াল! ভবিষ্যতে হয়তো বিজ্ঞানীরা স্ত্রী প্রাণিদের দীর্ঘায়ু হওয়ার কারণটা আরও নির্দিষ্ট ভাবে বলতে পারবেন।
তথ্যসূত্রঃ https://www.sciencedaily.com/releases/2020/03/200324131821.htm