অবাক বিশ্বজীববিজ্ঞান

“বায়োনিক গার্ল অলিভিয়া” যার খিদে পায়না, ঘুম আসেনা এমনকি ব্যাথাও অনুভব করেনা!

ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের কাছে হাডারফিল্ড নামে একটা শহর আছে। সেখানে বাস করে ফার্নসওয়ার্থ পরিবার। গৃহকর্তা রিড, তাঁর স্ত্রী নিকি ও তাঁদের পাঁচ ছেলেমেয়ে। পৃথিবীর অধিকাংশ চিকিৎসক আজ এই পরিবারটিকে চেনেন, পরিবারের মেজ মেয়ে অলিভিয়ার জন্য। এগারো বছর বয়সি অলিভিয়া পৃথিবীতে কিছু ব্যাপারে অদ্বিতীয়া। অলিভিয়ার এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে যা পৃথিবীতে কারও নেই। ছোট্ট অলিভিয়া দিনের পর দিন, না খেয়ে, না ঘুমিয়ে থাকতে পারে। যত বড় আঘাতই পাক না কেন, অলিভিয়া কোনও যন্ত্রণা অনুভব করে না। এগারো বছরের জীবনে একদিনও কাঁদেনি এই মেয়ে।

অলিভিয়া

সারা দিন রাত জেগে থাকতো অলিভিয়া 

এগারো বছর আগে ফার্নসওয়ার্থ পরিবারে এসেছিল ফুটফুটে অলিভিয়া। কয়েক মাসের মধ্যে মেয়ের কাণ্ড দেখে, আতঙ্কিত বাবা মা মেয়েকে কোলে করে ছুটেছিলেন চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসককে বলেছিলেন, মেয়ে খিদে পেলে কাঁদে না, দিনে রাতে একদম ঘুমোয় না। চিকিৎসক হেসে ফার্নসওয়ার্থ দম্পতিকে আশ্বস্ত করেছিলেন। বলেছিলেন এটা স্বাভাবিক, আপনারা বেশি খাইয়ে দিচ্ছেন তাই খিদেয় কাঁদছে না। আর ঘুমটা নিয়ে সব বাবা মা’র চিন্তা, ওটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। কিছুদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে আপনা থেকেই।

ধীরে ধীরে বড় হয়েছে অলিভিয়া, খিদের জ্বালায় মেয়ে কাঁদে না দেখে মা বাবা নির্দিষ্ট সময় অন্তর জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা করতেন। অনেক সাধ্যসাধনার পর মেয়ে যদিও বা সামান্য কিছু খেতো, কিন্তু কিছুতেই ঘুমোতে চাইতো না। সারাক্ষণ তাকে নিয়ে খেলতে হতো। দিনে বা রাতেও ঘুমাতে দিত না মেয়ে। অলিভিয়ার দাদা দিদিরা যখন ঘুমিয়ে কাদা,ছোট্ট  অলিভিয়া  টলোমলো পায়ে সারা বাড়ি জুড়ে ঘোরাঘুরি করতো। সারা রাত ধরে। বাধ্য হয়ে ফার্নসওয়ার্থ দম্পতি শিশু অলিভিয়াকে রাতে একটি খালি ঘরে ঢুকিয়ে, খেলনা দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতেন। তাঁদেরও তো ঘুমোতে হবে। দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে তাঁরাও যে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন।

খিদে নেই ঘুম নেই তবুও সুস্থ আছে অলিভিয়া।
চিকিৎসক জানিয়েছিলেন এক জটিল গঠনগত ত্রুটির শিকার অলিভিয়া

একবছরের কেটে যাওয়ার পরেও অলিভিয়ার এই সব অভ্যাসের কোনও পরিবর্তন হয়নি। তাই অন্য এক চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন ফার্নসওয়ার্থ দম্পতি। সব শুনে সেই চিকিৎসক অলিভিয়াকে পাঠিয়েছিলেন একটি ল্যাবরেটরিতে। সেখানে অলিভিয়ার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছিল। রিপোর্ট নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন দম্পতি। রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকের মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর ফোন করেছিলেন বিভিন্ন জায়গায়। রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

কয়েক দিন পর অলিভিয়ার বাবা মাকে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, অলিভিয়া ‘ক্রোমোজোম সিক্স-পি ডিসঅর্ডার’ নামের একটি জটিল গঠনগত ত্রুটির শিকার। তাই অলিভিয়ার খিদে ও ঘুম পায়না। অলিভিয়ার বাবা মাকে চিকিৎসক বলেছিলেন, “এ রোগের কোনও ওষুধ নেই। অলিভিয়াকে বাঁচাতে গেলে তাকে সময়ে সময়ে খাইয়ে দিতে হবে, কিন্তু ঘুমের জন্য কিছু করা যাবে না। কারণ এইটুকু মেয়েকে ঘুমের ওষুধ দেয়া যাবে না। না ঘুমিয়েও সুস্থ আছে যখন সেটাই থাকতে দিন।”

ভাইবোনদের সাথে অলিভিয়া,আছেন মা নিকিও।
‘সিক্স-পি ডিসঅর্ডার’ কী!

মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় ভ্রুণের কোষগুলি বারবার বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ তৈরি করে। ফলে গর্ভস্থ সন্তানের দেহে কোষের সংখ্যা দ্রুত ও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কিন্তু অলিভিয়া যখন মায়ের পেটে বেড়ে উঠছিল, তার কোষের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবে বাড়লেও বিভাজনের ত্রুটির জন্য অলিভিয়ার দেহের কোশগুলিতে ‘সিক্স-পি’ ক্রোমোজোম উপাদানটি ছিল না।অলিভিয়া স্বাভাবিকভাবে ভূমিষ্ঠ হলেও স্থায়ী ভাবেই অলিভিয়ার দেহে থেকে গিয়েছিল কোষের গঠনগত ত্রুটি। অলিভিয়ার দেহ থেকে ‘সিক্স-পি’ ক্রোমোজোম মুছে যাওয়ার সাথে তার জীবন থেকে মুছে গিয়েছিল অলিভিয়ার খিদে ও ঘুম পাওয়ার অনুভুতিও।

খেলছে অলিভিয়া
ধরা পড়েছিল অলিভিয়ার আর এক অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য 

রোজ বিকেলে বাড়ির সামনের পার্কে তার ভাইবোনদের সঙ্গে খেলা করতে যেত অলিভিয়া। একদিন অলিভিয়া একা গিয়েছিল পার্কে। পার্ক থেকে ফেরার পর অলিভিয়াকে দেখে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন মা নিকি। অলিভিয়ার নীচের ঠোঁটের অর্ধেকটা কেটে ঝুলছিল। জামা রক্তে ভেজা, কিন্তু অলিভিয়ার মুখে ছিল হাসি। আতঙ্কিত মায়ের পাশ দিয়ে ঘরে ঢুকে জুতো খুলতে শুরু করেছিল অলিভিয়া। মুখে একটুও ব্যথার অভিব্যক্তি ছিল না।

হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল অলিভিয়াকে, প্রথমে স্টিচ ও পরে প্লাস্টিক সার্জারি করতে হয়েছিল। পুরো সময়টিতে একবারের জন্যেও কাঁদেনি অলিভিয়া। হাসিমুখে ইঞ্জেকশনের পর ইঞ্জেকশন নিয়ে গেছিল। চিকিৎসকেরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তারপরেও অসংখ্যবার আঘাত পেয়েছে অলিভিয়া, কিন্তু তার মুখ থেকে একবার ‘‘আহ” শব্দটিও বের হয়নি।

ঠোঁট কাটার পরে সেলফি তুলেছিল অলিভিয়া।

২০১৬ সাল, অলিভিয়া তখন ৭ বছরের মেয়ে। মায়ের সঙ্গে বিকেলে পার্কে হাঁটতে বেরিয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই মায়ের হাত ধরছিল না। ফলে না দেখে রাস্তা পার হতে গিয়ে ভয়ঙ্কর এক দূর্ঘটনার কবলে পড়েছিল অলিভিয়া। অলিভিয়ার ছোট্ট শরীরটাকে ধাক্কা মারার পর ঠেলতে ঠেলতে একশো ফুট দূরে নিয়ে গিয়েছিল একটি গাড়ি।

পথচলতি মানুষজন চিৎকার করে উঠেছিলেন। মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে ছুটে গিয়েছিলেন অলিভিয়ার মা। তিনি ও বাকি সবাই নিশ্চিত ছিলেন যে অলিভিয়া আর বেঁচে নেই। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে অলিভিয়া উঠে দাঁড়িয়েছিল। দৌড়ে মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল। অলিভিয়ার মুখে ভয় বা আতঙ্কের লেশমাত্র ছিল না। অলিভিয়ার মুখের অভিব্যক্তি দেখে তার মায়ের মনে হয়েছিল, সে মাকে বলতে চাইছিল, কী হয়েছে, এত চিন্তার কী আছে!

হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর অলিভিয়ার শরীরে কয়েকটি আঁচড়ের দাগ ছাড়া আর কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। পুরো শরীর স্ক্যান করেও শরীরের ভেতরে কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ডাক্তাররা আগে থেকেই চিনতেন অলিভিয়াকে। তাঁরা জানতেন অলিভিয়ার খিদে আর ঘুম পায় না। তাঁরা নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন কোনও অবস্থাতেই অলিভিয়া যন্ত্রণাও অনুভব করে না।

পৃথিবীর প্রথম ‘বায়োনিক চাইল্ড’ অলিভিয়া
পৃথিবীর প্রথম ‘বায়োনিক চাইল্ড’ অলিভিয়া

এই দুর্ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের সঙ্গে অলিভিয়ার চিকিৎসকদের ফোন এবং ই-মেল চালাচালি শুরু হয়েছিল। কিছুদিন পরে জিনগত রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অলিভিয়াকে পৃথিবীর প্রথম ‘বায়োনিক চাইল্ড” বলে ঘোষণা করেছিলেন। এর অর্থ, অলিভিয়া অস্বাভাবিক সহ্যক্ষমতাযুক্ত একটি শরীর ও মন নিয়ে জন্মেছে, এই পৃথিবীতে অলিভিয়ার মত সহ্যশক্তি কারও নেই। সে কয়েকমাস না ঘুমিয়ে, কয়েক সপ্তাহ না খেয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে, আর অলিভিয়ার শরীর যেকোনও আঘাত ও যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে ঠিক রোবটের মতো।

সারা পৃথিবী তন্নতন্ন করে খুঁজে আজ অবধি একশো তিন জন মানুষকে পাওয়া গিয়েছে, যাদের ‘সিক্স-পি’ ক্রোমোজোম ডিসঅর্ডার আছে। কিন্তু এই তিনটি বৈশিষ্ট একত্রে বিশ্বে আর কোনও মানুষের দেহে কখনও দেখতে পাওয়া যায়নি। চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে অলিভিয়াই প্রথম মানুষ যার শরীরে No pain, No sleep, No hunger এই তিনটি উপসর্গই আছে। যা বিজ্ঞান ও চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা।

প্রচার মাধ্যমগুলি অলিভিয়াকে ‘লৌহমানবী’ আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকদের মতে, এটা একদমই অনৈতিক ও অযৌক্তিক। অলিভিয়া অসুস্থ। রক্তমাংসের মানুষ অলিভিয়ার জীবন, সাধারণ মানুষের চেয়ে শত শত গুণ ঝুঁকি পূর্ণ। তার তিনটি বৈশিষ্ট্যের যেকোনও একটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। এটা বিশ্ব না বুঝলেও বুঝে গিয়েছে ছোট্ট অলিভিয়া। তাই ‘ডক্টর-আঙ্কেল’দের কথা ছাড়া, আজ আর কারও কথাই শোনে না ছোট্ট অলিভিয়া।

তথ্যসূত্রঃ https://www.dailymail.co.uk/health/article-3401566/amp/The-bionic-girl-doesn-t-eat-rarely-sleeps-didn-t-feel-pain-dragged-street-car.html

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button