অবাক বিশ্ব

সমুদ্রের তলদেশ যখন ডেটা সেন্টারের ভবিষ্যত

ক্লাউড কম্পিউটিং আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিচ্ছে। ডিজিটালাইজেশনের যুগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তথ্য, অর্থাৎ ডেটা। যোগাযোগ, কর্মক্ষেত্র, পড়াশোনা, অবসরসহ নিত্যদিনের যেকোনো কাজের পুরোটাই নির্ভর করে আছে এই তথ্যের উপর। তো এই বিশাল পরিমাণ তথ্যের ঠিকানা কোথায়? কোথায় গিয়ে জমা হচ্ছে আমাদের জীবনের খুঁটিনাটি? উত্তর- ডেটা সেন্টার। বিশালাকার জায়গা জুড়ে শত শত সার্ভার নিয়ে তৈরি করা হয় একটি ডেটা সেন্টার। কিন্তু যে হারে তথ্যের সংখ্যা বেড়ে চলছে, এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করাও ততটা কঠিন হয়ে পড়ছে।

এজন্য ডেটা রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রক্রিয়া সহজতর করে তুলতে মাইক্রোসফট ২০১৮ সালে এক অভিনব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যে সিদ্ধান্ত হয়তো ভবিষ্যতের ডেটা স্টোরেজ সিস্টেমই পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। মাইক্রোসফটের এই পদক্ষেপ যেমন ব্যতিক্রম, তেমনি তাদের সফলতা ডেটা সেন্টারের চিন্তাধারায় অপার সম্ভাবনার মাত্রা যুক্ত করেছে। ল্যান্ড ডেটা সেন্টারের পরিবর্তে আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টারের উদ্যোগ কেন?

ল্যান্ড ডেটা সেন্টার বনাম আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টার

আমরা জানি যেকোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসই ধারাবাহিক ব্যবহারে তাপ উৎপন্ন করে, আর এই সার্ভারগুলো নিরলসভাবে চলতেই থাকে। এতে যে প্রচুর পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয় তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডেটা সেন্টারগুলোতে ভালো রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এছাড়া বায়ুতে থাকা অক্সিজেন, ধূলিকণা ইত্যাদিও সার্ভারের জন্য ক্ষতিকর। তো সার্ভারগুলোকে যদি বদ্ধ পরিবেশে রেখে পানিতে রাখা যায় তাহলে শীতলীকরণের দায়িত্ব পানির উপরেই ছেড়ে দেয়া যায়! অনেকেটা নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের মতো, সমুদ্রকে তাপশোষক হিসেবে ব্যবহার করা। শুধু শীতলীকরণই নয়, এর পেছনে আরো কিছু কারণ রয়েছে, যেগুলো যে কাউকেই মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে।

সাধারণত ভূমিতে কোনো ডেটাসেন্টার তৈরি করার জন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে হয়:

  • কমপক্ষে ২০ একর ফাঁকা ভূমি,
  • পর্যাপ্ত পানিসম্পদ,
  • শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুৎ, এবং
  • তুলনামূলক কম প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভাবিত এলাকা।

পাঠক বুঝতেই পারছেন- এমন এলাকা পাওয়া যেমন কঠিন, তেমন একটি ডেটা সেন্টার তৈরিতে আর্থিক ও ভৌগলিক ক্ষেত্র বিবেচনায় রাখতে হয় যা অধিক ডেটাসেন্টার তৈরির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বাধা হিসেবে দাড়ায়। এছাড়া, ডেটা সেন্টারগুলো বসতি থেকে দূরে হয় যা ডেটা ট্রাভেলের (পিং) সময় বাড়িয়ে তোলে, অর্থাৎ একজায়গা থেকে আরেকজায়গায় ডেটা পৌঁছাতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়।

data center
একটি ল্যান্ড-বেজড ডেটা সেন্টার; Image Source: Techquickie

কিন্তু বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার বসবাস উপকূল থেকে ১২০ মাইলের মাঝেই। তো, যদি ডেটা সেন্টারগুলো সমুদ্রে স্থাপন করা যায় তাহলে ডেটা ট্রাভেল টাইম অনেক কমে আসে। ফলে গেমিং, ব্রাউজিং আরো ভালভাবে করা সম্ভব। এছাড়া, মাইক্রোসফটের এই ডেটা সেন্টারগুলো এক নাগাড়ে ৫ বছর ফুল-চেকাপ ছাড়াই চলতে সক্ষম এবং একটি ক্যাপসুল তৈরিতে সময় লাগবে মাত্র ৯০ দিন। অর্থাৎ ল্যান্ড-বেজড ডেটা সেন্টারগুলো তৈরিতে যে বিশাল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা, এখানে নেই বললেই চলে। মার্কেটের চাহিদানুযায়ী খুব দ্রুতই এই ডেটা সেন্টারগুলো তৈরি করা যাবে। এছাড়া এসবের অকৃতকার্যের হার গতানুগতিক ডেটা সেন্টারের তুলনায় মাত্র ১/৮ ভাগ। ডেটা সেন্টারের ভেতরে অক্সিজেনের বদলে নাইট্রোজেন ব্যবহার করা হয় যা ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জামকে দীর্ঘায়ু প্রদানে সহায়তা করে।

সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে- এই ডেটা সেন্টারগুলো নবায়নযোগ্য। ডেটা সেন্টারটির কন্টেইনার ও অভ্যন্তরীণ সরঞ্জাম সবই তৈরি করা হয় পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান দিয়ে। এবং নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে চলতে সক্ষম কিনা এটি পরীক্ষার জন্যই মাইক্রোসফট ডেটা সেন্টারটি অর্কনি আইল্যান্ডে স্থাপন করে। দ্বীপের পুরোটাই প্রায় নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে চালিত। অর্থাৎ সমুদ্রের তলদেশের এই ডেটা সেন্টারগুলো পরিবেশবান্ধবও।

প্রশ্ন উঠতে পারে- এই ডেটা সেন্টারগুলো সামুদ্রিক প্রাণীদের উপর কোনো প্রভাব ফেলে কিনা। উত্তর হচ্ছে- না; বরং বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী ডেটা সেন্টারটির আশেপাশে নিজেদের আবাস্থল তৈরি করে বলে জানায় মাইক্রোসফট। এর সাথে এই ডেটা সেন্টারগুলো কোনো গ্রিন হাউজ ইফেক্ট তৈরি করে না, যা ভবিষ্যত জলবায়ুর জন্য এক বড় আশার বাণী। বলা যায়, মাইক্রোসফটের এই প্রজেক্ট শুধু প্রযুক্তিগত উপকারই নয়, করছে পৃথিবীর উপকারও।

তাহলে কি আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টার হতে যাচ্ছে ডেটা-স্টোরেজের ভবিষ্যৎ?

ল্যান্ড-বেজড ডেটা সেন্টারের তুলোনায় আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টারগুলো প্রযুক্তিগত,আর্থিক ও পরিবেশগত দিক থেকে নিঃসন্দেহে আদর্শ এবং ভবিষ্যতে এর সংখ্যা অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এরই সাথে যে ল্যান্ড-বেজড ডেটা সেন্টারগুলোও উধাও হয়ে যাবে এমনটি নয়। শুরুতে বলা হয়েছিল- বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশ জনসংখ্যার বসবাস উপকূলের ১২০ মাইলের আশেপাশে, কিন্তু বাকি ৫০ শতাংশের নির্বিঘ্ন সেবা নিশ্চিত করার জন্য ল্যান্ড-বেজড ডেটা সেন্টারের প্রয়োজন। এছাড়া ছোট স্টার্টআপগুলোর জন্য সমুদ্রের চেয়ে ভূমিতে ডেটা সেন্টার করা লাভজনক।তবে মাইক্রোসফটের প্রজেক্ট ন্যাটিক নিঃসন্দেহে নজর কেড়েছে অন্য টেক কোম্পানিগুলোরও। চীন ইতোমধ্যে একটি পরীক্ষামূলক ডেটা সেন্টার জুহাইয়ে উদ্বোধন করেছে, যা দেখতে অনেকটা প্রজেক্ট ন্যাটিকের মতোই!

প্রজেক্ট ন্যাটিকের সূচনা

বলা যায়, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীর অন্যতম প্রধান শত্রু হচ্ছে পানি। যেখানে সামান্য পানি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের কার্যক্ষমতা নিমিষেই শেষ করে দেয়, সেখানে সাগরের তলদেশে এতগুলো সার্ভার বসানোর কথা তো চিন্তাই করা যায় না। এর উপর নোনা পানি, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জলজ জীব তো আছেই। এই অবাস্তব চিন্তাধারাকে বাস্তবে নিয়ে এসেছে মাইক্রোসফটের প্রজেক্ট ন্যাটিক, যা পৃথিবীর সর্বপ্রথম আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টার।

চিন্তার শুরু ২০১৪ সালে মাইক্রোসফটের এক ইভেন্টে, যেখানে কর্মীরা তাদের অভিনব আইডিয়াগুলো শেয়ারের সুযোগ পান। এখানেই মার্কিন নেভির সাবেক কর্মী ও মাইক্রোসফটের গবেষক সান জেমস তার আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টার আইডিয়া তুলে ধরেন এবং মাইক্রোসফটও সেই বছরেই এটি বাস্তবে রূপদানের জন্য নেমে পড়ে।

data center
২টি র‍্যাকে কন্টেইনারে ঢোকান হচ্ছে সার্ভারসমূহ; Image Source: Microsoft

ডেটা সেন্টারটি প্রায় ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের, এতে রয়েছে ১২টি র‍্যাক এবং সেখানে সর্বমোট ৮৬৪টি সার্ভার রয়েছে। ২০১৮ সালে সার্ভারটি স্থাপন করা হয় সমুদ্রের ১১৭ ফুট তলদেশে এবং ২ বছর সফলভাবে কাজ করার পর ২০২০ সালে এটি পুনরায় উত্তোলন করা হয়। এটি ছিল প্রজেক্ট ন্যাটিকের ফেজ ২ (Phase-2) এর পরিচালনা।

প্রজেক্ট ন্যাটিক ৩টি ফেজের সমন্বয়ে তৈরি। প্রথম ফেজ শুরু হয় ২০১৫ সালে, ক্যালিফোর্নিয়ার শান্ত পানিতে ডেটা সেন্টারটি ডোবানোর মধ্য দিয়ে। ১০৫ দিন ডুবন্ত অবস্থায় রেখে এর ভবিষ্যত সম্ভাব্যতা যাচাই করেন গবেষকরা। যার ফলাফলে আশাবাদী হয়ে ২০১৮-তে ফেজ-২ শুরু করা হয়। ফেজ-২ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টারের ধারণাটি পরিবেশ ও অর্থনৈতিকভাবে কতটা যুক্তিযুক্ত তা যাচাই করা।

ফেজ-২ এর জন্য মাইক্রোসফট ফ্রান্সের Naval Group নামক কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়, যাদের কাজ ছিল সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা ও নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করা। তারাই ডেটা সেন্টারটির জন্য ভেসেল ডিজাইন ও ম্যানুফ্যাকচার করে। সমুদ্রের পানির সাথে তাপ আদান-প্রদানের জন্য সাবমেরিনের কুলিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়।

১২ মাস বিদ্যুৎ ব্যয়, আর্দ্রতার মাত্রা, তাপমাত্রা ইত্যাদি পরীক্ষার পর ২০২০ সালের ৯ জুলাই ডেটা সেন্টারটি আরো বিশ্লেষণ করার জন্য আবার উত্তোলন করা হয়। এর মাঝে দিয়ে ফেজ-২ সম্পন্ন হয়। পরবর্তী ফেজের উদ্দেশ্য ডেটা সেন্টারের স্থায়িত্ব পরীক্ষা করা, যা প্রক্রিয়াধীন।

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button