চিকিৎসা

কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে তৎক্ষণাৎ যা করবেন

কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে তার আশপাশে যারা থাকেন – প্রায়শই তারা তাৎক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে জানেন না। অনেকেই ঘাবড়ে যান।

কিন্তু খুব সহজ কিছু বিষয় জানা থাকলে বহু মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব।

নিজেকে বাঁচিয়ে অন্যকে সহায়তা

এরকম বহু ঘটনা রয়েছে যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার পর পাশের মানুষটি তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন।

অগ্নিকাণ্ড এবং দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক একেএম শাকিল নেওয়াজ বলছেন, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে প্রথমে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করতে হবে।

“এতে আক্রান্ত ব্যক্তি বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। কিন্তু সংযোগ বন্ধ করা সম্ভব না হলে, কোনভাবেই নিজে খালি হাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যক্তিকে স্পর্শ করা যাবে না।”

পায়ে জুতো বা স্যান্ডেল পরে, শুকনো কাঠের টুকরো, বাঁশ, রাবার দিয়ে তৈরি কোনকিছু দিয়ে, দূরত্ব বজায় রেখে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যক্তিকে বৈদ্যুতিক উৎস থেকে আলাদা করতে হবে।

সেটি করতে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে জোরে আঘাত করে ফেলেন অনেকে – যা করা যাবে না, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

কোনভাবেই ধাতব এবং ভেজা কিছু ব্যবহার করা যাবে না। এর কোন কিছুই করা সম্ভব না হলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বিদ্যুৎ অফিসে খবর দেয়া উচিৎ।

ভেজা যায়গায় ঘটনাটি ঘটলে নিজেকে বাঁচাতে সেখান থেকে সরে যাওয়াই ভাল।

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে যেসব শারীরিক সমস্যা হয়

‘ক্রিটিকাল কেয়ার এবং ইমারজেন্সি মেডিসিন’ বিশেষজ্ঞ ডা. রাগিব মনজুর বলছেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে সবচেয়ে বড় শারীরিক সমস্যা দুটো।

“একটি হলো পুড়ে যাওয়া এবং অন্যটি হল হৃদযন্ত্রের উপরে চাপ সৃষ্টি হওয়া। তিনি বলছেন, অনেক সময় ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যক্তি মারাও যেতে পারেন।”

“এছাড়া বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে স্নায়ুর উপর চাপ তৈরি হয়, আক্রান্ত ব্যক্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন। শরীরের যে অংশে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন সেই অংশ অথবা পুরো শরীর অবশ হয়ে যেতে পারে, ঝিমঝিম করতে পারে, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা হতে পারে। ”

শাকিল নেওয়াজ বলছেন, আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক সমস্যা কতটা গুরুতর হবে তা নির্ভর করে বিদ্যুতের ভোল্টেজের মাত্রা, কতক্ষণ বিদ্যুতের সাথে তার সংস্পর্শ ছিল, তার হার্ট অথবা অন্য কোন শারীরিক সমস্যা আছে কিনা – এসব কিছুর উপরে।

“এছাড়া বিদ্যুৎ দুই ধরনের, এসি কারেন্ট এবং ডিসি কারেন্ট। এসি কারেন্ট আকর্ষণ করে টেনে রাখে আর ডিসি কারেন্ট ধাক্কা মেরে ব্যক্তিকে ফেলে দেয়। এসি কারেন্ট বেশি বিপজ্জনক। “

আবাসিক ভবনে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা হলে তার ভয়াবহতা কম হয় – কারণ বিদ্যুতের ভোল্টেজ কম থাকে। ঢাকা শহরে অগ্নিকান্ডের ৭৫ শতাংশই বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ঘটে।

সহজ কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা

ডা. রাগিব মনজুর বলছেন, আপনার প্রিয়জন কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখা জরুরী। তিনি সহজ কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার কথা জানিয়েছেন।

কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলছেন যে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর পুড়ে গেলে, হার্টের সমস্যা হলে, অবস্থা গুরুতর হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

হাসপাতালে না নেয়া পর্যন্ত তাকে বালিশ ছাড়া মাটিতে একপাশে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে। শরীরের কাপড় ঢিলা করে দিতে হবে।

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যক্তির শরীরে রক্তসঞ্চালন বাড়াতে মালিশ করে দেয়া যেতে পারে। জিহ্বা উল্টে গেছে কিনা পরীক্ষা করুন, উল্টে গেলে আঙুল দিয়ে তা সোজা করে দিন।

নাক-মুখে কিছু আটকে থাকলে তা পরিষ্কার করে দিতে হবে – তা না হলে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসরোধ হয়ে যেতে পারে।

শ্বাসকষ্ট হলে তাকে ‘সিপিআর’ দিতে হবে – যা বাংলাদেশে অনেকেই পারেন না।

আক্রান্ত ব্যক্তির থুতনি ও চোয়াল ধরে মুখ কিছুটা হাঁ করে, সেখানে নিজের মুখ লাগিয়ে জোরে জোরে ফুঁ দিতে হবে।

হৃদযন্ত্রের অবস্থানের উপর অনেক জোরে দুই হাত দিয়ে চাপ দিতে হবে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বিদ্যুৎ সংযোগে যেসব সতর্কতা দরকার

বাংলাদেশে অসতর্কতার কারণেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে, বলছেন বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা একেএম শাকিল নেওয়াজ।

তিনি বলছেন, প্রায়ই কাটা বিদ্যুতের তার পড়ে থাকে বিভিন্ন যায়গায়।

“বিদ্যুতের তার, সুইচ এবং সংযোগের জন্য দরকারি অন্যান্য যন্ত্র নিয়মিত পরীক্ষা করা, ত্রুটি থাকলে তা সারিয়ে নেয়া, দরকার হলে তার বা সুইচ ইত্যাদি বদলে ফেলার অভ্যাসও নেই অনেকের।”

তিনি বলছেন, বিদ্যুতের তার টেপ দিয়ে জোড়া লাগানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।

“ঘরে যত্রতত্র মাল্টি-প্লাগ ব্যবহার করা উচিত নয়। ঘর যাতে স্যাঁতসেঁতে না থাকে এবং বিদ্যুতের উৎসের কাছাকাছি ভেজা কিছু না থাকে – সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ”

শাকিল নেওয়াজ বলছেন, অন্য কোথাও থেকে অবৈধ সংযোগ নেয়ার ফলে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। এর অন্যতম কারণ জোড়া দেয়া তার বৃষ্টিতে ভিজে যায়।

শাকিল নেওয়াজ বলছেন, “বিদ্যুতের কাজে খরচ বাঁচানোর চেষ্টা না করে মানসম্পন্ন তার ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কিনতে হবে। যত কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হবে – সেই চাপ নেয়ার উপযুক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে।”

তিনি বলছেন, প্রায়ই দেখা যায় কোন ভবন তৈরির পর ইচ্ছেমত এসি ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক সামগ্রী বসানো হচ্ছে – যা বিদ্যুতের লোড বাড়িয়ে দেয়।

“কোন সমস্যা হলে বিদ্যুৎ সংযোগ নিজেই বন্ধ হয়ে যাবে এমন অটোমেটিক সার্কিট ব্রেকার এবং মেইন সুইচ থাকা খুবই জরুরী। সবসময় ‘আর্থিং’ করা থাকতে হবে।”

এমনকি কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের সময়ও একই ধরনের ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button