পদার্থবিজ্ঞান

রেডিওথেরাপির ভেতর-বাহির

আমাদের শরীরের প্রত্যেকটি কোষ নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। বিভাজনের মাধ্যমে শরীরে কোষের সংখ্যা বাড়ে। কোষ বিভাজন শরীরের নিয়মিত ঘটনা। সাধারণত একটি কোষ নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজিত হবার পর আর বিভাজিত হয় না। তখন কোষটির মৃত্যু ঘটে। শরীরের সবগুলি কোষেরই একই নিয়ম।

কিন্তু কোন কারণে কোষের ডি-এন-এ বিন্যাস যদি এলোমেলো হয়ে যায়, কোষের নিয়মানুবর্তিতা বদলে যেতে পারে। তখন কোন কোন কোষ অনবরত বিভাজিত হতে থাকে এবং রূপ নেয় ক্যান্সারে। কেন এবং কীভাবে একটি সাধারণ কোষ ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়—তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা কী কী কারণে বাড়ে তা জানা গেছে। বিজ্ঞানীরা এসব কারণকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করেছেন: ফিজিক্যাল কারসিনোজেন্স, কেমিক্যাল কারসিনোজেন্স, ও বায়োলজিক্যাল কারসিনোজেন্স।

ফিজিক্যাল কারসিনোজেন্স প্রধানত আয়োনাইজিং রেডিয়েশান—যেমন এক্স-রে, গামা-রে, আলট্রাভায়োলেট রে ইত্যাদি শরীরে ঢুকে ডিএনএকে আঘাত করে। আহত ডিএনএকে মেরামত করতে গিয়ে আমাদের শরীরের রিপেয়ার মেকানিজম মাঝে মাঝে ভুল করে ফেলে। তখন কোন কোন কোষ ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়ে যেতে পারে। কেমিক্যাল কারসিনোজেনের তালিকায় অনেক রাসায়নিকের নাম নেয়া যায়। বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়া, আর্সেনিক, অ্যাসবেস্টোস, কলকারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক ইত্যাদি।

বায়োলজিক্যাল কারসিনোজেন হতে পারে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, এককোষী পরজীবী ইত্যাদি। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস যে ক্যান্সারের কারণ ঘটায় তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি বলেই এখনো মানুষ ক্যান্সারের কাছে অনেকটাই অসহায়। মানুষের গড় আয়ু ক্রমশ বাড়ছে। তার সাথে সাথে বাড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা। এখন বৃদ্ধ বয়সে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ৭৫ বছর বয়সী প্রতি চারজন নারীর মধ্যে একজনের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা আছে। আর একই বয়সী তিনজন পুরুষের মধ্যে একজনের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা আছে। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ক্যান্সার চিকিৎসারও অনেক উন্নতি ঘটেছে। তবুও বছরে প্রায় এক কোটি মানুষ মারা যায় ক্যান্সারে।

প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা গেলে ক্যান্সার চিকিৎসায় রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ক্যান্সার নির্ণয়ে আমরা আগের অধ্যায়গুলিতে দেখেছি এক্স-রে, সিটি, এমআরআই, ম্যামোগ্রাফি, নিউক্লিয়ার মেডিসিন প্রভৃতি কীভাবে ভূমিকা রাখে। ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও নিউক্লিয়ার মেডিসিনের ভূমিকা আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। ক্যান্সার চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে রেডিওথেরাপিতে। ক্যান্সার রোগীদের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ তাদের চিকিৎসার কোনো না কোনো পর্যায়ে রেডিওথেরাপি নেন।

রেডিওথেরাপির প্রধান লক্ষ্য হলো তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে স্বাভাবিক কোষের কোন ক্ষতি না করে ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলা। কিন্তু শরীরে ক্যান্সার কোষগুলি কোনো না কোনভাবে স্বাভাবিক কোষ পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে। ফলে ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলতে গেলে স্বাভাবিক কোষও মারা যায়। খুব বেশি স্বাভাবিক কোষ মারা গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তখন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যেতে পারে, কিংবা স্বাভাবিক কোষে রেডিয়েশানের প্রতিক্রিয়ায় সেকেন্ডারি ক্যান্সারের সূচনা হতে পারে। আবার অন্যদিকে যদি ক্যান্সার কোষের সবগুলি মারা না গিয়ে কয়েকটিও অবশিষ্ট থেকে যায়—সেগুলি থেকে আবার নতুন ক্যান্সার কোষের কলোনি তৈরি হতে পারে। ফলে পুরো চিকিৎসাই ব্যর্থ হয়ে যায়।

ক্যান্সার টিউমারের স্থান, পর্যায়, রোগীর বয়স এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি অনেক বিষয় বিবেচনা করে চিকিৎসাপদ্ধতি ঠিক করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপিই হতে পারে একমাত্র চিকিৎসা, কোন কোন ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি দেয়ার পর রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ক্যান্সার টিউমার অপসারণের আগে রেডিওথেরাপি দেয়া হয় অপারেশানের সুবিধার্থে টিউমারকে সংকুচিত করার জন্য। ক্যান্সার টিউমার অপারেশানের পরেও অনেক ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি দেয়া হয় যেন কোন ক্যান্সার কোষ বেঁচে না থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে রোগীর কষ্ট কমানোর জন্য কম মাত্রার প্যালিয়েটিভ রেডিওথেরাপি দেয়া হয়।

রেডিওথেরাপি প্রয়োগের পদ্ধতি অনুসারে রেডিওথেরাপিকে প্রধানত দুইভাবে ভাগ করা যায়—টেলিথেরাপি বা এক্সটার্নাল রেডিওথেরাপি এবং ব্রাকিথেরাপি বা ইন্টার্নাল রেডিওথেরাপি। রোগীর শরীর স্পর্শ না করে রেডিয়েশান যদি দূর থেকে প্রয়োগ করা হয়, তাকে টেলিথেরাপি বা এক্সটার্নাল রেডিওথেরাপি বলা হয়। আর যদি রেডিয়েশানের উৎস রোগীর টিউমারের ভেতর স্থাপন করে দেয়া হয় তাকে ব্রাকিথেরাপি বা ইন্টারনাল রেডিওথেরাপি বলা হয়।

অনকোলজিস্ট যদি রেডিওথেরাপি দেয়ার জন্য পরামর্শ দেন, তখন রোগীর রেডিওথেরাপির আয়োজন করা হয়। ক্যান্সার হাসপাতালে প্রথমে রোগীর সিটি স্ক্যান করে টিউমারের অবস্থান, আকার এবং অন্যান্য অবস্থার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তারপর ট্রিটমেন্ট প্ল্যানিং করা হয় যেন টিউমারের বেশি বাইরে রেডিয়েশান না যায়, এবং সবচেয়ে বেশি ক্যান্সার কোষ এবং সবচেয়ে কম স্বাভাবিক কোষ মারা যায়। এক সাথে অনেক বেশি ডোজের রেডিয়েশান দিলে সব ক্যান্সার কোষ তাড়াতাড়ি মারা যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু একই সাথে স্বাভাবিক কোষও মারা যাবে। তাই এক সাথে বেশি ডোজ দেয়া হয় না। মোট ডোজকে স্বাভাবিক কোষের জন্য সহনীয় কয়েকটি ডোজে ভাগ করে নির্দিষ্ট সময় পর পর (২৪ ঘন্টা বা ৪৮ ঘন্টা পর পর) দেয়া হয়। স্বাভাবিক কোষ যেগুলি রেডিয়েশানের প্রতিক্রিয়ায় আহত হয়, কিছু সময়ের বিরতি পেলে তারা নিজেদের সুস্থ করে তুলতে পারে। কিন্তু ক্যান্সার কোষের মেরামতের ক্ষমতা স্বাভাবিক কোষের তুলনায় কম। ফলে এভাবে ক্যান্সার কোষ স্বাভাবিক কোষের চেয়ে বেশি মারা যায়।

এক্সটার্নাল রেডিওথেরাপি দেয়া হয় প্রধানত উচ্চ শক্তির এক্স-রে, গামা-রে, কিংবা ইলেকট্রন প্রয়োগের মাধ্যমে। গামা রে প্রয়োগ করা হয় কোবাল্ট মেশিনের সাহায্যে, এক্স-রে ও ইলেকট্রন প্রয়োগ করা হয় লিনিয়ার এক্সিলেটারের মাধ্যমে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, কোরিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে প্রোটন রেডিওথেরাপিও দেয়া হচ্ছে। এই পদ্ধতিগুলির প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা পদার্থবিজ্ঞান আছে।

গামা-রে রেডিওথেরাপি

১৯৫০ এর দশকে এক্সটার্নাল রেডিওথেরাপির ব্যবহার শুরু হবার পর থেকে কোবাল্ট মেশিন খুবই কার্যকরভাবে রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করে আসছে। এই মেশিনের ট্রিটমেন্ট হেডে থাকে কোবাল্ট-৬০ আইসোটোপ যেখান থেকে ১.২৫ মিলিয়ন ইলেকট্রন-ভোল্ট শক্তির গামা রশ্মি নির্গত হয়। এই গামা রশ্মি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান অনুযায়ী রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়। কোবাল্ট-৬০ নিউক্লিয়ার আইসোটোপ। এটা সবসময় গামা রশ্মি বিকিরণ করতে থাকে। ট্রিটমেন্ট হেডে এই আইসোটোপ পুরু সীসার আবরণের মধ্যে থাকে বলে সেই বিকিরণ বাইরে আসতে পারে না। রেডিওথেরাপি দেয়ার সময় রোগীর দিকে সীসার আবরণে একটা জানালা খুলে যায়। এই জানালার ক্ষেত্রফল টিউমারের আকারের উপর নির্ভর করে।

কোবাল্ট মেশিনে রোগীকে শুধুমাত্র আয়তাকার বা বর্গাকার জানালা দিয়ে গামা রে দেয়া হয়, কিন্তু টিউমার বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। ফলে অনেক বেশি স্বাভাবিক কোষের মৃত্যু হয়। মেশিনে সবসময় রেডিয়েশান তৈরি হয় বলে কোবাল্ট মেশিন থেকে রেডিয়েশান ছড়ায় বেশি। কোবাল্ট আইসোটোপের অর্ধায়ু ৫.৩ বছর। সারাক্ষণই রেডিয়েশান সোর্সের তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে প্রতিবার রেডিওথেরাপি দেয়ার আগে এর তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ হিসেব করতে হয়, এবং সেই অনুযায়ী রেডিওথেরাপির সময় বাড়তে থাকে। ১৯৭০ সালে মেগাভোল্টেজ এক্স-রে মেশিন লিনিয়ার এক্সিলারেটর উদ্ভাবিত হবার পর কোবাল্ট-৬০ মেশিনের বদলে লিনিয়ার এক্সিলারেটরের ব্যবহার বাড়তে থাকে।

এক্স-রে রেডিওথেরাপি

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক্স-রে’র ব্যবহার শুরুর পর থেকেই ইমেজিং-এর পাশাপাশি থেরাপিতেও এক্স-রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রেডিওগ্রাফির জন্য সর্বোচ্চ ১৫০ কিলো-ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তির এক্স-রে ব্যবহার করা হয়। এই শক্তির এক্স-রে প্রয়োগ করে কিছু কিছু টিউমারে থেরাপিও দেয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে ত্বকের ক্যান্সার টিউমার—মুখে, কানে, নাকে, কপালে কিংবা কাঁধের টিউমার অপসারণে এধরনের সুপারফিসিয়াল এস্ক-রে থেরাপি দেয়া হয়। এক্স-রে বিমের শক্তি কম হওয়াতে অনেকক্ষণ ধরে এক্স-রে প্রয়োগ করতে হয়।

এক্স-রে’র শক্তি ১৫০ থেকে ৪০০ কিলো-ইলেকট্রন ভোল্ট ব্যবহার করে ডিপ রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। এ ধরনের এক্স-রে টিউবের অ্যানোড ও ক্যাথোডের মধ্যে দেড় লক্ষ থেকে চার লক্ষ ভোল্ট চালনা করা হয়। হাড়ে যদি ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে তখন রোগীর যন্ত্রণা কমানোর জন্য ডিপ এক্স-রে রেডিওথেরাপির মাধ্যমে প্যালিয়েটিভ রেডিওথেরাপি দেয়া হয়।

কিলোভোল্টেজ এক্স-রে (সুপারফিসিয়াল এবং ডিপ) তুলনামূলকভাবে খুব সহজে প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু এতে রোগীর ত্বকে অনেক বেশি রেডিয়েশান শোষিত হয়। অনেকক্ষণ ধরে দিতে হয় বলে রোগীর ত্বক পুড়ে যেতে পারে। ত্বকের অনেক গভীরে গিয়ে পৌঁছাতে পারে না এই এক্স-রে। ফলে যেসব টিউমার ত্বকের গভীরে থাকে তাদের চিকিৎসায় খুব ভালো ফল পাওয়া যায় না। এই সমস্যা মিটে যায় মেগাভোল্টেজ এক্স-রে বা মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তির এক্স-রে প্রস্তুত করার পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে।

সাধারণ এক্স-রে যেভাবে উৎপাদন করা হয় সেভাবে মেগা ভোল্ট এক্স-রে তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ এক্স-রে টিউবের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ যত ভোল্টেজ চালনা করা হয়, সেখান থেকে সর্বোচ্চ সেই শক্তির এক্স-রে উৎপাদন করা যায়। যেমন ১২০ কিলোভোল্ট চালনা করলে সর্বোচ্চ ১২০ কিলো ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তির এক্স-রে পাওয়া যায়। নবম অধ্যায়ে আমরা দেখেছি এক্স-রে কীভাবে উৎপন্ন হয়। সেই পদ্ধতিতে মেগা ভোল্টেজ এক্স-রে উৎপাদন করতে হলে এক্স-রে টিউবে মিলিয়ন ভোল্ট চালনা করতে হবে যা এক্স-রে জেনারেটর থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। মেগাভোল্ট এক্স-রে উৎপাদন করার ব্যবস্থা হলো লিনিয়ার এক্সিলাটেরের মাধ্যমে। মেডিকেল লিনিয়ার এক্সিলারেটরের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৫৩ সালে লন্ডনে। পরের বছর শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে।

এক্স-রে উৎপাদন করার সময় হাই ভোল্টেজ প্রয়োগের ফলে ফিলামেন্টের ইলেকট্রন প্রচণ্ড বেগ প্রাপ্ত হয়। ইলেকট্রন যত বেগে অ্যানোড বা টার্গেটকে ধাক্কা দেয়, তত বেশি শক্তির এক্স-রে উৎপন্ন হয়। লিনিয়ার এক্সিলারেটরে মিলিয়ন ভোল্ট প্রয়োগের বদলে অন্যভাবে ইলেকট্রনের গতি বাড়ানো হয়। এখানে ইলেকট্রনের ত্বরণ বাড়ানো হয় বেতারতরঙ্গের মাধ্যমে কম্পন তৈরির মাধ্যমে। এক্সিলারেটরের ইলেকট্রন গান থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়ে একটা লম্বা নলের (ওয়েভ গাইড) ভেতর দিয়ে অন্যদিকের টাংস্টেন টার্গেটের দিকে যেতে থাকে। তখন এই নলের মধ্যে বেতারতরঙ্গ প্রয়োগ করা হয়। প্রায় তিন মেগাহার্জের বেতার তরঙ্গ ওয়েভ গাইডের ইলেকট্রনকে সেকেন্ডে তিন মিলিয়ন বা তিরিশ লক্ষ বার আন্দোলিত করে। এটা অনেকটা দোলনায় চড়ার মতো। এত জোরে দোলানোর পর সেই ইলেকট্রন যখন টাংস্টেন টার্গেটে ধাক্কা দেয় তখন এত জোরে ধাক্কা দেয় যে সেখান থেকে মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টের এক্স-রে উৎপন্ন হয়। লিনিয়ার এক্সিলারেটরের মাথা—যাকে ট্রিটমেন্ট হেড বলা হয়—সেখানে থাকে দুই ধরনের ফিল্টার। এই ফিল্টারের ভেতর দিয়ে এক্স-রে বের হবার সময় এক্স-রে বিমের সব এক্স-রের শক্তি প্রায় একই মানের হয়ে যায়। ট্রিটমেন্ট হেডে মাল্টিলিফ কলিমেটর লাগানো যায়। এই মাল্টিলিফ কলিমেটরের মাধ্যমে এক্স-রে বিমের যে কোন আকৃতি দেয়া যায়। টিউমারের আকার ও আকৃতি অনুযায়ী এক্স-রে বিম প্রয়োগ করা যায় টিউমারে।

আধুনিক রেডিওথেরাপির রেডিয়েশান ডেলিভারির পুরোটাই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। রোগীকে ট্রিটমেন্ট কাউচে এমনভাবে সেট করতে হয় যেন এক্স-রে বিম সরাসরি টিউমারে প্রবেশ করতে পারে। লিনিয়ার এক্সিলারেটর টিউমারের চারদিকে ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরতে পারে। কোন্‌ দিক থেকে কত ডোজের রেডিয়েশান প্রয়োগ করা হবে তা ট্রিটমেন্ট প্ল্যানে নিখুঁতভাবে হিসেব করা থাকে। প্ল্যানে ভুল হলে রোগী প্রয়োজনের অতিরিক্ত রেডিয়েশান পেতে পারে। ফলে অনেক বেশি স্বাভাবিক কোষের মৃত্যু হতে পারে। যা অনাকাঙ্খিত। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলে নির্দিষ্ট ডোজের এক্স-রে প্রয়োগ করার জন্য রেডিওথেরাপির অনেক ধরনের প্রয়োগ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। যেমন, থ্রি-ডাইমেনশানাল কনফর্মাল রেডিয়েশান থেরাপি (3D-CRT), ইন্টেন্সিটি মডুলেটেড রেডিওথেরাপি (IMRT), ইমেজ গাইডেড রেডিওথেরাপি (IGRT) ইত্যাদি।

প্রোটন রেডিওথেরাপি

এক্স-রে রেডিওথেরাপির একটা বড় অসুবিধা হলো—টিউমারে রেডিয়েশান পৌঁছার পর অতিরিক্ত রেডিয়েশান টিউমারের বিপরীত দিকে বের হয়ে যাবার সময় স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি করে। তাই কিছু কিছু টিউমারের রেডিওথেরাপি দেয়ার সময় অনেক ঝুঁকি থেকে যায়। যেমন, চোখের টিউমার কিংবা ব্রেন টিউমারে এক্স-রে প্রয়োগ করলে এক্স-রে টিউমার ছাড়িয়ে অন্যান্য কোষ ভেদ করে ফেলে। এক্স-রে ডোজের ছড়িয়ে পড়াটা বন্ধ করার উপায় নেই। কিন্তু প্রোটনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে—প্রোটন বিম খুবই সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যস্থলে প্রয়োগ করা যায়, সব ডোজ ওখানেই থেমে থাকে। তাই প্রোটন বিম কিছু কিছু ক্যান্সারের চিকিৎসায় এক্স-রে বিমের চেয়ে কার্যকর। যেমন চোখের ও ব্রেনের টিউমারের রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রে। ব্রেন স্টেম ও স্নায়ুতন্ত্রের কাছে কোন টিউমার থাকলে সেসবের ক্ষেত্রেও প্রোটন থেরাপি এক্স-রে থেরাপির চেয়ে ভালো।

প্রোটন বিম উৎপাদন করার জন্য লিনিয়ার এক্সিলেটারের চেয়ে অনেক বড় সিনক্রোট্রন বা সাইক্লোট্রনের দরকার হয়। এর খরচ অত্যন্ত বেশি। কমপক্ষে ১০ কোটি ডলার খরচ হয় একটি প্রোটন মেশিন স্থাপন করতে।

ইন্টারনাল রেডিওথেরাপি

ইন্টারনাল রেডিওথেরাপি বা ব্রাকিথেরাপিতে রোগীর শরীরে টিউমারের কাছাকাছি বা টিউমারের ভেতর রেডিও-আইসোটোপ স্থাপন করা হয়। এই রেডিও-আইসোটোপ থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বের হয়ে টিউমারের ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে ফেলে। টিউমার ও রোগীর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন ডোজের বিভিন্ন ধরনের আইসোটোপ প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত জরায়ু, গর্ভাশয়, প্রোস্টেট ইত্যাদির টিউমারে ব্রাকিথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। ব্রাকিথেরাপিতে রোগীর শরীর থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটে। তাই যতদিন এই তেজস্ক্রিয়তা থাকে রোগীকে যথাসম্ভব আলাদা রাখা উচিত।

ব্রাকিথেরাপি

রেডিওথেরাপির কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। রেডিওথেরাপির সময় স্বাভাবিক কোষও কিছুটা রেডিয়েশন শোষণ করে। তার প্রভাবে রোগীর মাথা ঘুরতে পারে, বমি আসতে পারে, খাবার রুচি চলে যেতে পারে, চামড়া খসখসে হয়ে যেতে পারে, চামড়া ফেটে গিয়ে অনেকসময় ঘা হতে পারে, চুল পড়ে যেতে পারে, মুখের ভেতর এবং গলা শুকিয়ে যেতে পারে, দাঁতে সমস্যা দেখা দিতে পারে, খাবার গিলতে বা চিবুতে সমস্যা হতে পারে, বুকে ব্যথা হতে পারে, পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে, ডায়রিয়া হতে পারে, প্রশ্রাবে সমস্যা হতে পারে। ক্যান্সার থেকে পরিত্রাণের জন্য এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সহ্য করতে হয় রোগীকে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ক্যান্সার চিকিৎসার উন্নতি হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে হিউম্যান জিনোম ব্যবহার করে ক্যান্সার রোগের জন্য দায়ী জিন শনাক্ত করা যাবে বলে আশা করা যায়। তখন ক্যান্সার চিকিৎসায় আরো অনেক বেশি রোগীর প্রাণ বাঁচবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button