ট্রাকিলোস ফুটপ্রিন্ট: এই পায়ের ছাপগুলো কি মানবজাতির উৎস সম্পর্কে প্রচলিত তত্ত্বকে উড়িয়ে দিচ্ছে?
গ্রিসের ক্রিট দ্বীপে পাওয়া কিছু পায়ের ছাপকে ৬০ লক্ষ বছরের পুরনো বলে মনে করা হয়। পৃথিবীর বুকে মানবসদৃশ কোন প্রাণীর এটাই প্রাচীনতম চিহ্ন । কিন্তু সাধারণত যেটা মনে করা হয় যে – মানবজাতির উদ্ভব ঘটেছিল আফ্রিকায় এবং প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে তারা বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রিট দ্বীপের আবিষ্কারের সাথে এই তত্ত্ব একেবারেই খাপ খায় না। তাই বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মানবজাতির উৎস সম্পর্কে এক নতুন বিতর্ক। আরো একটা প্রশ্ন: এগুলো কি সত্যি মানুষের পায়ের ছাপ?
এই পায়ের ছাপগুলো পোলিশ জীবাশ্মবিদ জেরার্ড গিয়েরলিনস্কি খুঁজে পেয়েছিলেন ২০০২ সালে । তখন থেকেই বিজ্ঞানী মহলে এগুলো পরিচিত ছিল ‘ট্রাকিলোস ফুটপ্রিন্ট’ নামে ।
কিন্তু নতুন এক জরিপে দাবি করা হচ্ছে – মানুষের পূর্বপুরুষদের অস্তিত্বের এধরনের যত প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে এটিই প্রাচীনতম।
অক্টোবর মাসের ১১ তারিখ সায়েন্টিফিক রিপোর্টস নামে এক জার্নালে এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। মানবজাতির উৎস সম্পর্কে এতকাল যে ধারণা মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য ছিল – তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে নানা দেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত গবেষক দলটির লেখা ওই নিবন্ধ।
সহজ কথায় প্রচলিত তত্ত্বটি হলো: বিশ্বের অন্য যে কোন জায়গার আগে আফ্রিকাতে ‘হোমিনিন’দের উদ্ভব ও বিবর্তন হয়েছিল। আধুনিক মানুষ, বিলুপ্ত মানব প্রজাতিসমূহ, এবং আমাদের নিকটতম পূর্বপুরুষদের সবাইকে একসঙ্গে বোঝাতে হোমিনিন শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
মানবজাতির উৎস আফ্রিকায়
বিপুলসংখ্যক জীবাশ্মবিদ মনে করেন আফ্রিকাই হচ্ছে মানবপ্রজাতির মাতৃক্রোড়।
এই তত্ত্বে বলা হয় মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল আফ্রিকা মহাদেশেই, তবে তার পরে তাদের এক ‘মহা অভিবাসন’ ঘটে। মানুষেরা পৃথিবীর বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, যা শুরু হয়েছিল ২০ লক্ষ বছর বা তার কিছু কম সময় আগে।
কিন্তু নতুন এই গবেষণা দলটির নেতা – সুইডিশ জীবাশ্মবিদপ পার আহলবার্গ এই কাল-নিরুপণকে চ্যালেঞ্জ করছেন। তিনি বলছেন, ট্রাকিলোসের পায়ের ছাপগুলো ৬০ লক্ষ বছরের পুরোনো।
এর আগে মানব-সদৃশ পায়ের ছাপের প্রাচীনতম প্রত্যক্ষ নমুনা বলে মানা হতো ‘লেটোলি ফুটপ্রিন্টস’কে – যা ১৯৭৬ সালে পাওয়া গিয়েছিল তানজানিয়ায়।
কিন্তু পার আহলবার্গের দাবি – তানজানিয়ার পায়ের ছাপের চাইতেও প্রায় ২৫ লক্ষ বছর বেশি পুরোনো এই ট্রাকিলোস ফুটপ্রিন্টস।
মানবজাতির একটা ফ্যামিলি ট্রি বা বংশপরিচয় তৈরির ক্ষেত্রে আফ্রিকা পাওয়া নিদর্শনগুলোর ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকায় গত ১০০ বছরে পায়ের ছাপ ছাড়াও প্রাক-মানব যুগের অসংখ্য ফসিল বা জীবাশ্ম পাওয়া গেছে।
এর একটি হচ্ছে ‘সাহেলানথ্রোপাস’-এর মাথার খুলি। অনুমান করা হয় ৭০ লক্ষ বছর আগে তার বাস ছিল আফ্রিকায়। এটিই হচ্ছে আজ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো হোমিনিন নমুনা।
তুলনামূলকভাবে ইউরোপে এ ধরনের অস্থির জীবাশ্ম পাওয়া গেছে খুবই কম।
ক্রিটের এই পায়ের ছাপ কার?
ট্রাকিলোস ফুটপ্রিন্ট নিয়ে ২০১৭ সালে প্রথম যে গবেষণাপত্রটি লেখা হয় সেই দলেরও অংশ ছিলেন পার আহলবার্গ।
সেই গবেষণাপত্রটিতে আহলবার্গ এবং তার সহকর্মীরা বলেছিলেন, এই পায়ের ছাপগুলো হোমিনিনদের পায়ের ছাপের মত। কারণ এতে বুড়ো আঙুলটি যেভাবে অন্য আঙুলগুলোর কাছাকাছি হয়ে আছে – তার সাথে গরিলা বা শিম্পাঞ্জির মত অন্য ‘প্রাইমেট’ বা বানরজাতীয় প্রাণীদের পায়ের গড়নের মিল নেই।
আহলবার্গ বিবিসিকে বলেন, “নন-হিউম্যান এপ (মানব- শ্রেণীভুক্ত নয় এমন বানরজাতীয় প্রাণী) -দের পায়ের ছাপ দেখতে খুবই অন্যরকম। তাদের পা দেখতে অনেকটা মানুষের হাতের মত। তাদের বুড়ো আঙুলটা শুরু হয়েছে পায়ের পাতার একপাশে এবং কিছুটা নিচের দিক থেকে এবং সেটা বাইরের দিকে মুখ করা।”
“অন্যদিকে আমাদের সমগোত্রীয় প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষের বুড়ো আঙুল পায়ের পাতার লম্বালম্বি অক্ষরেখার সমান্তরাল, তা একপাশে বেরিয়ে-থাকা নয়।”
বিজ্ঞানীদের মনে সংশয়
কিন্তু আহলবার্গদের এই আবিষ্কারকে কিছু জীবাশ্মবিদ সংশয়ের চোখে দেখছেন।
সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন – এই পায়ের ছাপ বিশ্লেষণে অনুসৃত পদ্ধতি নিয়ে। কয়েকজন তো এমন কথাও বলেছেন যে এগুলো আসলে হয়তো কোন পায়ের ছাপই নয়।
যুক্তরাজ্যের বোর্নমাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পায়ের ছাপ বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ বেনেট গ্রিসে ওই পায়ের ছাপগুলো পরীক্ষাকারী দলের সদস্য ছিলেন।
কিন্তু এমনকি তিনিও এর মূল্যায়ন নিয়ে সন্দিহান।
“এগুলো খুবই কৌতুহলোদ্দীপক পায়ের ছাপের ফসিল – হয়তো কোন দুপেয়ে প্রাণী – কোন এক ধরনের এপ – এই ছাপ রেখে গিয়েছে।” বিবিসিকে বলছেন অধ্যাপক বেনেট।
“আর এগুলো যদি মানবজাতির কোন পূর্বসুরীর পায়ের ছাপ হয়ে থাকে – তাহলে তো অন্য ব্যাপার।”
বেনেট কেন ইতস্তত করছেন তা বুঝতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে ইউরোপে হোমিনিন হাড়ের ফসিল পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া মানুষের বিবর্তনের কালপঞ্জীও মোটেই সহজ-সরল ব্যাপার নয়।
জীবাশ্মবিদরা মনে করেন যে ওরাংওটান, গরিলা, শিম্পাঞ্জী, এবং মানুষ – যাদেরকে বলা হয় গ্রেট এপস (Great Apes) বা বৃহদাকার বানরজাতীয় প্রাণী – তাদের উদ্ভব ও বহুমুখী বিকাশ ঘটেছিল প্রায় ৫০ লক্ষ থেকে ২ কোটি ৩০ লক্ষ বছর পর্যন্ত আগেকার একটা সময়ে। এই কালপর্বটিকে বলা হয় মায়োসিন যুগ।
কিন্তু ঠিক কোন সময়টায় অন্য ‘এপ’দের থেকে মানুষ ‘আলাদা হয়ে যেতে’ শুরু করে – তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে খুব কমই মতৈক্য আছে।
বিজ্ঞানীরা এমন প্রমাণ পেয়েছেন যে মানবজাতীয় নয় এমন ‘গ্রেট এপ’রা ইউরোপে বিচরণ করেছে। কাজেই এটা হতে পারে যে তারাই হয়তো ক্রিটে পায়ের ছাপ রেখে গেছে – এমনটা মনে করেন অধ্যাপক রবিন ক্রম্পটন, যিনি হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল এ্যানথ্রোপলজির একজন বিশেষজ্ঞ।
“এই পায়ের ছাপগুলো হয়তো কোন হোমিনিনের হতে পারে, এবং সেটা খুবই আগ্রহ-উদ্দীপক। কিন্তু এখনো এ নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে যার জবাব পেতে আরো গবেষণা এবং আবিষ্কার দরকার” – বিবিসিকে বলেন অধ্যাপক ক্রম্পটন।
অন্য কথায় – আমাদেরকে ইউরোপে আরো হাড় ও পায়ের ছাপ পেতে হবে।
ট্রাকিলোস ফুটপ্রিন্ট আবিষ্কার কত গুরুত্বপূর্ণ?
আহলবার্গ বলছেন, এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের প্রজাতি অর্থাৎ হোমো সেপিয়েন্সের উদ্ভব হয়েছিল আফ্রিকায় প্রায় ৩০০,০০০ বছর আগে। কিন্তু তার আগ্রহ আমাদের ইতিহাসের আগেকার পর্ব নিয়ে।
“হোমো সেপিয়েন্সের উৎস যে আফ্রিকাতেই – তার পক্ষে অনেক প্রমাণ আছে” – বলছেন তিনি, “প্রশ্নটা হচ্ছে, তারও অনেক আগে মানবজাতির সমগ্র বংশধারাটা আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল কিনা।
“হয়তো তা নয়। আমাদের গবেষণায় আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে মানুষের প্রাচীনতম পূর্বপুরুষরা হয়তো ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল এবং পূর্ব আফ্রিকাতেও বিচরণ করতো।” বলছেন আহলবার্গ।
আহলবার্গ ‘আফ্রিকা তত্ত্ব’ ভুল প্রমাণ করতে চান না বরং তিনি বলছেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা হয়তো এখন আমরা যা মনে করি তার অনেক আগেই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল” – এমন একটা সম্ভাবনা নিয়েই তিনি কাজ করছেন।
“আমরা যা বলছি তা হচ্ছে, একেবারে প্রথম যুগের এই হোমিনিনরা যে এলাকাটাতে ঘুরে বেড়াতো তা হয়তো – আমরা যা ভাবতে অভ্যস্ত – তার চেয়ে অনেক ব্যাপক ছিল।”
ট্রাকিলোস ফুটপ্রিন্টস নিয়ে প্রথম গবেষণাপত্র যখন বের হচ্ছে – সেই ২০১৭ সালেই জার্মান জীবাশ্মবিদ, টুবিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেডেলিন বোহম নিজেই একটি আবিষ্কারের কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন
তিনি ঘোষণা করেন, মানুষ এবং শিম্পাঞ্জীর “শেষ অভিন্ন পূর্বপুরুষ” আবিষ্কৃত হয়েছে – এবং তাকে খুঁজে পাওয়া গেছে আফ্রিকাতে নয়, ইউরোপে।
বোহম এবং একটি গবেষকদল দাবি করেন, এই প্রাণীটির – যার নাম দেয়া হয়েছে গ্রেকোপিথিকাস – আবাসস্থল ছিল বলকান অঞ্চলে ৭০ লক্ষ ১৮ হাজার থেকে ১৭ লক্ষ ২৫ হাজার বছর আগের কোন এক সময়।
তার মানে এটি সাহেলানথ্রোপাসের চেয়েও পুরোনো, এবং মানুষের যে সর্বপ্রাচীন পূর্বপুরুষ প্রথম সোজা দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারতো বলে আজ অবধি মনে করা হয় – তা হচ্ছে এই সাহেলানথ্রোপাস।
এখন পর্যন্ত গ্রেকোপিথিকাসের দেহাবশেষ যা পাওয়া গেছে তা হচ্ছে একটি দাঁত এবং একটি চোয়ালের হাড়। হাড়টি পাওয়া গিয়েছিল গ্রিসে, ক্রিট থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে।
বোহম বলছেন,”মানুষের বিবর্তনের ৫০ লক্ষ বছর আগের ইতিহাসকে আমাদের অনুসন্ধান চ্যালেঞ্জ করছে না, প্রশ্ন তুলছে তারও আগে কি হয়েছিল তা নিয়ে।”
বিতর্ক ও বিজ্ঞান
ট্রাকিলোস ফুটপ্রিন্টস নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে – তাতে বিজ্ঞানীরা একটি ব্যতিক্রমী তত্ত্বকে কিভাবে দেখেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
রবিন ক্রম্পটন বলছেন, ট্রাকিলোস ফুটপ্রিন্টস নিয়ে তার সংশয় থাকলেও “এগুলো আদৌ কোন হোমিনিনের পায়ের ছাপ কিনা” ধরনের কথাবার্তা বলে একে উড়িয়ে দেয়া তিনি সমর্থন করেন না।
তার মতে, এ প্রবণতা মানবজাতির উৎস সম্পর্কে গবেষণার জন্য সহায়ক নয়।
“এগুলোকে উড়িয়ে না দিয়ে বরং আরো অনুসন্ধান করা উচিত। বিজ্ঞানীদের মন খোলা রাখতে হবে।” বলেন তিনি।
মেডেলিন বোহম এব্যাপারে একমত। তিনি বলছেন, মানবজাতির উৎস সম্পর্কে তত্ত্বের ক্ষেত্রে আগেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯২৪ সালে যখন ২৮ লক্ষ বছরের পুরোনো ‘তাউং শিশু’ নামে পরিচিত একটি নবজাতকের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল – তার পর “আফ্রিকা তত্ত্ব” দেয়া হলেও তা কিন্তু সাথে সাথেই ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়নি।
“এরকম সময় ছিল যখন মনে করা হতো আফ্রিকা নয় বরং পৃথিবীর নানা স্থানে মানবজাতির উদ্ভব হয়েছিল” বলছেন বোহম।
“সংশয়বিহীন বিজ্ঞান ভালো বিজ্ঞান নয়, ভিন্ন যুক্তির ব্যাপারে মন খোলা রাখা দরকার। এটা ঠিক যে আমাদের আরো অনুসন্ধান ও আবিষ্কার দরকার, কিন্তু আমাদের সহকর্মীরা আমাদের আবিষ্কারকে উড়িয়ে দিচ্ছে এটা একেবারেই অন্যরকম দেখায়।”
অধ্যাপক আহলবার্গ বলছেন, অনেকের মনে আফ্রিকা তত্ত্ব বদ্ধমূল হয়ে গেছে বলেই তাদের দাবিকে এভাবে দেখা হচ্ছে।
তার কথা, “জীবাশ্ম গবেষণা জগতের লোকেরা কী বলবে তা নিয়ে আমি চিন্তিত নই । আমরা আমাদের তত্ত্বের পক্ষে তথ্যপ্রমাণ দিয়েছি।”
পায়ের ছাপ চুরি
উপসংহারে বলা দরকার, ট্রাকিওস ফুটপ্রিন্টস নিয়ে যে শুধু বৈজ্ঞানিকরাই কৌতুহলী হয়ে উঠেছেন তাই নয়।
২০১৭ সালে তাদের আবিষ্কারের কথা ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ পরই কিছু পায়ের ছাপ চুরি হয়ে যায়।
আটটি পায়ের ছাপ বাটালি দিয়ে পাথর থেকে খুঁড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
গ্রিক পুলিশ পরে একজন স্থানীয় হাইস্কুল শিক্ষককে এ জন্য গ্রেফতার করে।
ফসিলগুলোও উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।