বিজ্ঞান ও ইতিহাস

বিজ্ঞানের যে আবিষ্কারগুলো বদলে দিয়েছিল বিশ্বকে

সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানবজাতি নিরাপদ, স্বচ্ছন্দ ও উন্নত জীবনযাপনের চেষ্টা করে আসছে। সে লক্ষ্যে যুগে যুগে ঘটেছে বিজ্ঞানের প্রসার; সম্ভব হয়েছে নিত্যনতুন যন্ত্রের আবিষ্কার। এভাবেই মানুষের সৃজনশীল চিন্তা পেয়েছে দৃশ্যমান অবয়ব। মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে মেধা ও মননশীলতার বিকাশে এ আবিষ্কারগুলোর রয়েছে অপরিসীম অবদান।

আদিম যুগ থেকে মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে কিংবা জীবনযাপন কে কিছুটা সহজ করতে বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করত, আবিষ্কার করত বিভিন্ন ধরণের জিনিস। তারা বিভিন্ন অস্ত্র ও সরল যন্ত্র তৈরি করত জীবনের ঝুঁকি কমাতে ও পরিশ্রম লাঘব করতে। নতুন নতুন উপায় ও পদ্ধতি দিয়ে বদলে ফেলত নিজেদের জীবনযাপনের ধারা। আগুন দিয়ে কিভাবে খাবার পুড়িয়ে খেতে হয় অথবা কিভাবে ঘর বানিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে হয় সবই মানব সভ্যতা আয়ত্ত করেছে ধীরে ধীরে। মানুষের এই নতুনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আর আবিষ্কারের নেশা মানুষকে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে গেছে সামনের দিকে।

বিজ্ঞান বলতে আমরা বুঝি কোন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান, আর এই বিশেষ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মানুষ যা কিছু আবিষ্কার করেছে তা ই হল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। তাই বলা যায় যে বিজ্ঞানের চর্চা মানুষ সে আদিম যুগ থেকেই করে আসছে। আদিম যুগ থেকেই মানুষ তাদের বিশেষ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে একের পর এক উদ্ভাবন করেছে নানান যন্ত্র ও পদ্ধতি।

তবে মানব ইতিহাসে এমন কিছু আবিষ্কার আছে যা কি না পরিবর্তন করে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে। আজ আমরা বিজ্ঞানের এমনই ১০ টি আবিষ্কার সম্পর্কে জানব, জানব কি ছিল এর পেছনের ইতিহাস।

১। চাকা

সম্ভবত মানুষের জীবন ধারাকে আমূল বদলে দেওয়া প্রথম আবিষ্কারটি ছিল চাকা। অনেকের মনে হতে পারে এটি আবার এমন কি আবিষ্কার। কিন্তু ৩৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই সামান্য আবিষ্কারটিই ছিল বিজ্ঞানের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন

একবার ভেবে দেখুন তো, বর্তমান সময়ে আমরা কতটা চাকার উপর নির্ভরশীল। দ্রুত একস্থান থেকে অন্যস্থানে গমন কিংবা ভারী মালপত্র বহনে আমরা যে যানবাহনের ব্যাবহার করি তার সূত্রপাত এই চাকার হাত ধরেই। সভ্যতার অগ্রগতিতে আমরা জলে, স্থলে বা আকাশে গমন করতে পারে এমন অনেক বাহন পেয়েছি কিন্তু সবকিছুর সূত্রপাত হয়েছে ৩৬০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের দিকে চাকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই। সভ্যতার শুরুতে মানুষকে পায়ে হেটে পথ পাড়ি দিতে হত। মালপত্র পরিবহন থেকে শুরু করে যে কোন পরিবহনের জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হত কায়িক শ্রমের উপর। মাঝে মাঝে মানুষ বিভিন্ন পশুকে তাদের এই পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করত। কিন্তু সেটিও ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত।

তবে চাকার আবিষ্কার বলতে ব্যাপারটি এমন ছিল না যে বৃত্তাকার বা সিলিন্ডার আকৃতির কোন কাঠামো তৈরি। সেরকম কোন কাঠামো মানুষ তারও আগেই শিখে ফেলেছিল। কঠিন বিষয়টি ছিল কিভাবে এই বৃত্তাকার কাঠামোকে কোন মজবুত ও স্থির কোন কাঠামোর সাথে যুক্ত করা যা চাকা গুলোকে ঘুরতে সাহায্য করবে। আর এই উপায়টিই মানুষ এই সময়ে এসে আয়ত্ত করে। আবার সভ্যতার সে সময়টিতে মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে একদম পিছিয়েও ছিল না। তখন মানুষ শিখে গিয়েছিল কিভাবে ধাতুর সংকর তৈরি করতে হয় এবং তা দিয়ে কিছু সূক্ষ্ম ও জটিল যন্ত্রপাতিও আবিষ্কার করতে হয়। শুধু সমস্যা টা ছিল এমন কোন আবিষ্কারের যার মাধ্যমে তাদের সময় ও পরিশ্রম দুই ই লাঘব হবে। এভাবে ধীরে ধীরে তারা সিলিন্ডার আকৃতির কোন কাঠামোকে মজবুত ও স্থির কোন কাঠামোর সাথে যুক্ত করে সেটিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গড়িয়ে নিতে পারে এমন পদ্ধতির আবিষ্কার করে।

২। কাগজ

আমরা মানব সভ্যতা কে বদলে দেওয়া বিজ্ঞানের ১০ টি আবিষ্কারের কথা বলছিলাম। আচ্ছা, এই মানব সভ্যতা বা সভ্যতার কথা ভাবতে গেলে আমাদের মাথায় কোন কথাটি আগে আসে? নিশ্চয়ই শিক্ষা! আর শিক্ষার কথা বলতে গেলে তর্কাতিত ভাবে চলে আসে কাগজের কথা।

কাগজ আবিষ্কারের ইতিহাস প্রায় 2,000 বছর পুরানো। তখন চীনারা কাপড়ের তৈরি চাদর কে বিভিন্ন ধরনের অংকন ও লেখার কাজে ব্যাবহার করত। তবে কাগজ বলতে বর্তমান সময়ে যেটি বুঝি তার আবিষ্কার হয়েছিল চীনের একজন কোর্ট অফিসিয়াল Ts’ai Lun এর হাত ধরে। তিনি তুঁতের বাকল, শাঁস এবং পানি মিশ্রিত করে এক ধরনের মণ্ড তৈরি করতেন। এই মণ্ডকে চাপ দিয়ে পাতলা করে তারপর তা রোদে শুকাতে দিতেন।

অষ্টম শতাব্দীর দিকে কাগজ তৈরির এই পদ্ধতি সম্পর্কে মুসলিম শাসকেরা জানতে পারেন এবং পরবর্তীতে তাদের হাত ধরে ইউরোপে এই পদ্ধতি ছড়িয়ে পরে।

এরপর স্পেনে প্রথম কাগজ কল স্থাপিত হয় এবং ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপে এরকম অসংখ্য কাগজ কল স্থাপিত হতে থাকে। অবশ্য তখন কাগজ শুধু দরকারি নথি ও বই ছাপাতে ব্যবহৃত হত। সর্বসাধারণের কাছে কাগজ পৌঁছে দেয় মূলত ব্রিটিশরা। ১৫ শতকের দিকে তারা বিশাল পরিসরে কাগজ উৎপাদন শুরু করে এবং উপনিবেশ ভুক্ত দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়। আর বর্তমানে কাঠ দিয়ে কাগজ তৈরির পদ্ধতিটি এসেছিল আমেরিকানদের হাত ধরে। আর এভাবেই আমরা পাই দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

৩। প্রিন্টিং প্রেস

পঞ্চদশ শতাব্দীর একটি অন্যতম আবিষ্কার হল প্রিন্টিং প্রেস। এটি হল এমন একটি যান্ত্রিক পদ্ধতি যা কোন কাগজ বা কাপড়ের পৃষ্ঠে চাপ প্রয়োগ করে কালি বা রঙ এর একটি আস্তরণ তৈরি করে। এই আস্তরণ হতে পারে কোন লেখা বা কোন নকশা বা চিত্র। আমাদের দেশে কয়েক বছর আগেও এমন পদ্ধতি ব্যাবহার করে লেখা বা চিত্র প্রিন্ট করা হত। তবে এখন মূলত অত্যাধুনিক লেজার প্রিন্টার বা অপটিকাল প্রিন্টার এর ব্যাবহার অধিক।

জোহানেস গুটেনবার্গ কে মূলত প্রিন্টিং প্রেস এর আবিষ্কারক হিসেবে মানা হয়। ১৪৪০ সালের দিকে তিনি এটি আবিষ্কার করেন। তিনি ছিলেন জার্মানির অধিবাসী এবং পেশায় একজন স্বর্ণকার। অবশ্য প্রিন্টিং এর ইতিহাস শুরু হয় আরও অনেক আগে থেকেই। গুটেনবার্গের এই আবিষ্কারের প্রায় ৬০০ বছর পূর্বে চীনা সাধকরা ব্লক প্রিন্টিং নামের একটি পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। এ পদ্ধতিতে কাঠের তৈরি কোন ব্লকে কালি লাগিয়ে কোন কাগজের পৃষ্ঠে নকশা বা লেখা প্রিন্ট করা হত। এ পদ্ধতির প্রচলন অষ্টম শতকে কোরিয়া এবং জাপানেও প্রচলিত ছিল। এরপর এশিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে চীনে ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটতে থাকে প্রিন্টিং পদ্ধতির।

এছাড়া পঞ্চদশ শতাব্দীতে জাইলোগ্রাফি নামক আরেকটি প্রিন্টিং পদ্ধতি প্রচলিত ছিল ইউরোপে। এটিও ছিল খানিকটা চাইনিজ সন্ন্যাসীদের ব্যবহৃত কাঠের ব্লক পদ্ধতির মতই। তবে সবকিছুর অবসান ঘটে গুটেনবার্গের আবিষ্কারের মাধ্যমে। তিনি এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা দিয়ে হাতে হাতে প্রেসিং করে মুদ্রণ করার বদলে একটি মেকানিক প্রেসিং করা যেত। তার এই যন্ত্রটি এসেম্বলি লাইন পদ্ধতি ব্যবহার করত যা ছিল হাতে প্রিন্টিং এর চেয়ে অধিকতর দক্ষ। ফলে পূর্বের চেয়ে উন্নত ও দ্রুত প্রিন্টিং এ যন্ত্রটি ছিল অনেকটাই এগিয়ে।

৪। টেলিফোন

টেলিফোন আবিষ্কার ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি কল্পনাতীত অধ্যায়। একবার ভাবুন তো, আমরা আধুনিক যুগে এসেও যখন মোবাইল ফোনে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য-প্রান্তে, দূর থেকে দূরান্তে কারও সাথে কথা বলি, একটু হলেও কি অবাক হই না। তাহলে বুঝুন এই যন্ত্র আবিষ্কারের পর মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল। বিজ্ঞানের এমন অনেক আবিষ্কার আছে যা আবিষ্কারের পূর্বে কাউকে বললে সে নির্ঘাত আপনাকে পাগল বলবে। টেলিফোন আবিষ্কার ছিল তেমনই একটা ব্যাপার।

আলেক্সেন্ডার গ্রাহামবেল কে টেলিফোনের আবিষ্কারক হিসেবে ধরা হলেও এ নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব আছে। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এবং ইলিশা গ্রে উভয়ই ওয়াশিংটনের পেটেন্ট অফিসে ১৮৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে টেলিফোন আবিষ্কারের পেটেন্ট এপ্লিকেশন জমা দেন। তবে গ্রাহামবেলের আবেদন টি আগে নিবন্ধিত হয়। ১৮৭৬ সালের মার্চে এই পেটেন্টটি নিবন্ধিত হয়। ১৮৭৬ সালের জুনে ফিলাডেলফিয়ার বিশ্ব প্রদর্শনীতে বেল প্রথমবারের মতো এক বিশাল দর্শক উপস্থিতির সামনে তার আবিষ্কৃত টেলিফোন উপস্থাপন করেছিলেন। এই যন্ত্রটি সফলতার সাথে একপ্রান্তে উচ্চারিত শব্দ অপর প্রান্তে পৌঁছে দিতে পারত।

অবশ্য গ্রামবেলের টেলিফোনটি ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে খানিকটা কষ্টসাধ্য ছিল। তবে ১৮৭৭ সালে বেল টেলিফোন কোম্পানি টেলিফোনকে সহজে ব্যবহারযোগ্য করে উৎপাদন শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে ইউরোপের বাজারে ছড়িয়ে দিতে থাকে।

৫। তড়িৎ

তড়িৎ শক্তি বর্তমান সময়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও একে সরাসরি বিজ্ঞানের আবিষ্কার বললে ভুল হবে। কেননা এটি সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতির অংশ। তবে হ্যাঁ, একে ব্যাবহার যোগ্য করে তোলাটা ছিল বিজ্ঞানের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

থেলিসের লেখা হতে জানা যায় যে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে পশ্চিমারা জানত এম্বার কে ঘষে চার্জিত করা যায়। তবে এর পর তড়িৎ আবিষ্কারে তেমন কোন অগ্রগতি হয় নি। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট বিভিন্ন পদার্থের তড়িতায়ন ব্যাখ্যা করেন এবং প্রথম ইলেক্ট্রিসিটি শব্দটি ব্যাবহার করেন যা কি না এম্বার এর গ্রিক অনুবাদ। এরপর ১৬৬০ সালে Otto von Guericke স্থির তড়িৎ উৎপাদনের একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন।

এরপর ১৭৫২ সালে, বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন তড়িৎ এবং বিদ্যুৎ চমকানোর মধ্যে সম্পর্ক দেখানোর জন্য একটি অদ্ভুত পরীক্ষা করেন। তিনি এক বর্ষার দিনে একটি ঘড়ি এবং চাবি ব্যাবহার করে পরীক্ষাটি করেছিলেন। তিনি বজ্র-বৃষ্টির সময় ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে সুতাটিকে একটি চাবির সাথে বেধে দিয়েছিলেন। তার ধারনা ছিল যে বজ্রপাতের কারণে মেঘ থেকে বৈদ্যুতিক চার্জ সুতা দিয়ে এসে চাবিতে জমা হবে। পরীক্ষা শেষে তিনি যখন চাবিটি স্পর্শ করেছিলেন তখন তিনি একটি ছোট বৈদ্যুতিক সক খান এবং তার ধারনাটি সঠিক প্রমাণিত হয়। এভাবে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বিদ্যুৎ আবিষ্কারের এবং ব্যাবহারের দ্বার উন্মোচন করেন। এজন্য তাঁকে বিদ্যুতের আবিষ্কারক বলা হয়।

পরবর্তীতে অবশ্য বিভিন্ন বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যুতের উন্নতি সাধিত হইয়। এদের মধ্যে হেনরি ক্যাভেন্ডিস, চার্লস কুলম্ব, ওহম প্রভৃতি বিজ্ঞানী উল্লেখযোগ্য।

৬। বৈদ্যুতিক বাতি

বৈদ্যুতিক বাতির উপকারিতা সম্পর্কে নতুন করে তেমন কিই বা বলার আছে। এর উপকারিতা বলে শেষ করার মত নয়। রাতের আধার দূর করে বৈদ্যুতিক বাতি শুধু আমাদের চারদিক আলোকিতই করে নি, এটি বরঞ্চ আলোকিত করেছে মানব সভ্যতার ভবিষ্যতকে।

আমরা জানি টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেন। তবে শুধু তার হাত ধরেই এটি সম্ভব হয়েছে বললে ভুল হবে। বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারের পেছনে অনেক বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের সূত্রপাত ঘটে ইতালীয় বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টার হাত ধরে ১৮০০ সালের দিকে। এরপর হাম্ফ্রি ডেভি নামের একজন বিজ্ঞানী ভোল্টাইক পাইলকে চারকোল ইলেক্ট্রোডের সাথে যুক্ত করে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর কৌশল দেখান। এভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের প্রক্রিয়া।

তবে এই যাত্রার শেষ হয় জোসেফ সোয়ান ও টমাস আলভা এডিসনের হাত ধরে। জোসেফ সোয়ান ১৮৫০ সালের দিকে ভ্যাকুয়াম টিউবের ভেতর ফিলামেন্ট রেখে বাতি জ্বালানোর কৌশল দেখান। ফিলামেন্ট হিসেবে তিনি ব্যাবহার করেন কার্বন যুক্ত কাগজ। তবে সে সময়ে এই ভ্যাকুয়াম টিউবের পদ্ধতি ছিল বেশ ব্যয়বহুল। ফলে তার এ পদ্ধতি শুধু আবিষ্কার হিসেবেই অসাধারণ ছিল দৈনন্দিন জীবনে ব্যাবহারের জন্য নয়।

টমাস আলভা এডিসন এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। তার ধারনাটি ছিল এমন যে যদি ফিলামেন্টটিকে পাতলা এবং কোন অধিক রোধের বস্তু দিয়ে তৈরি করা যায় তাহলে এটি খুব অল্প বিদ্যুতেই জ্বলে উঠবে। এই ধারনার উপর ভিত্তি করে তিনি ১৮৭৯ সালে তার আবিষ্কারটি প্রকাশ করেন। এর পর এডিসন ও তার দল বিভিন্নভাবে এই বাতিকে সহজলভ্য ও টেকসই করার জন্য বিভিন্ন ভাবে গবেষণা করে গেছেন।

যদিও বৈদ্যুতিক বাতির পেছনে অনেকের অবদান থাকায় এর পেটেন্ট নিয়ে বেশ জল ঘোলাই হয়েছিল। এডিসনের সাথে অনেক বিজ্ঞানীরই এ নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। তবে সব কিছু ছাপিয়ে এডিসনের এই আবিষ্কার মানব জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছিল।

৭। অন্তর্দাহ ইঞ্জিন

অন্তর্দাহ ইঞ্জিন হল এমন এক ধরনের ইঞ্জিন যাতে ইঞ্জিনের ভেতরে জ্বালানী এবং অক্সিজেনের মিশ্রণ প্রবেশ করানো হয়। একটি স্পার্ক এই জ্বালানীতে দহন ঘটিয়ে একটি ছোট বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে উৎপন্ন তাপ ও চাপে গ্যাসের প্রসারণ ঘটে। এই প্রসারণ ইঞ্জিনের পিস্টনে চাপ প্রয়োগ করে। এই প্রক্রিয়াটি ক্রমাগত চলতে থাকে এবং ইঞ্জিনকে সচল রাখে।

অন্তর্দাহ ইঞ্জিন আবিষ্কারের সূচনা ঘটে ১৭ শতকের গোঁড়ার দিকে। এ সময় কয়েকজন বিজ্ঞানী অন্তর্দাহ ইঞ্জিন তৈরির কাছাকাছি এসেছিলেন। এরপর ১৮৬০ সালে, জিন জোসেফ এতিয়েন লেনোয়ার নামে এক ব্যক্তি প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অন্তর্দাহ ইঞ্জিনের পেটেন্ট করেছিলেন। তবে এই ইঞ্জিনটিতে কেবল একটি সিলিন্ডার ছিল এবং এটি অতিরিক্ত গরম হয়ে যেত। এই ইঞ্জিনটি একটি তিন চাকার গাড়িকে ঘণ্টায় প্রায় দুই মাইল দূরত্ব অতিক্রমে সক্ষম ছিল।

অন্তর্দাহ ইঞ্জিন আবিষ্কারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৮৭৮ সালে। এই বছর নিকোলাস এ অটো বিশ্বের প্রথম ফোর-স্ট্রোক ইঞ্জিন তৈরি করেন। এই ইঞ্জিনটি অবিচ্ছিন্ন ভাবে চলতে সক্ষম ছিল। একই বছর শ্বার ডালাস ক্লার্ক সফলভাবে প্রথম দুই স্ট্রোক বিশিষ্ট ইঞ্জিন তৈরি করেছিলেন।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্তর্দাহ ইঞ্জিন আবিষ্কার ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। মানুষের জীবনযাপনের ধারায় গতি নিয়ে এসেছিল এই আবিষ্কার। বিভিন্ন ধরনের যানবাহন থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক কাজেই বহুল ব্যবহৃত এই অন্তর্দাহ ইঞ্জিন।

৮। এন্টিবায়োটিক

দেহের কোন অংশ কেটে গেলে, আঘাতপ্রাপ্ত হলে কিংবা পুড়ে গেলে সে ক্ষতস্থানে রোগজীবাণু সংক্রমণ ঘটায়। এ সকল রোগ কে সংক্রমণ রগ বলে থাকে। আর এই সংক্রমণ রোগের চিকিৎসায় সবচাইতে নির্ভরযোগ্য যে ঔষধ তা হল এন্টিবায়োটিক। এন্টিবায়োটিক হল বিভিন্ন অণুজীব থেকে প্রাপ্ত রাসায়নিক উপাদান যা রোগ জীবাণুর বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। তবে এটি শুধু ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের ক্ষেত্রেই কার্যকর, ভাইরাস জনিত রোগের জন্য নয়।

প্রাচীনকালে বিভিন্ন ছত্রাক আর গাছের লতা পাতার নির্যাস দিয়েই মূলত বিভিন্ন সংক্রমণের চিকিৎসা করতো মানুষ। প্রাচীন মিশরীয়রা ময়লা ছাতার মত দাগ পড়ে যাওয়া পাউরুটিকে সংক্রমণ স্থলে লাগিয়ে চিকিৎসা করতো। চীনাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা সয়াবিনের ছত্রাক আক্রান্ত বীজ ফোঁড়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করত। গ্রীক ও ভারতীয়দের ক্ষতস্থানের সংক্রমণ দূর করতে ছত্রাক ও বিভিন্ন উদ্ভিদের ব্যবহারের নজির পাওয়া গেছে। এভাবে বিভিন্ন সভ্যতা ও অঞ্চলের মানুষেরা সংক্রমণ রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করত।

জার্মানির শারীরতাত্ত্বিক পল এরলিক ১৯০৯ সালে শরীরের কোনোরূপ ক্ষতি না করেই আর্সফেনামিন নামক রাসায়নিক প্রয়োগে সিফিলিস রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া মারতে সক্ষম হন। আর এরই মাধ্যমে আধুনিক এন্টিবায়োটিকের যাত্রাপথ শুরু হয়।

তবে এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারে যার কথা টি না বললেই নয় তিনি হলেন আলেক্সেন্ডার ফ্লেমিং। তিনি ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন উন্নতি সাধনের পর ১৯৪৪ সালে পেনিসিলিন সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমান সময়ে এন্টিবায়োটিক চিকিৎসা পদ্ধতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

এই ছিল বিজ্ঞানের ১০ টি আবিষ্কার যা বদলে দিয়েছিল বিশ্বকে। তবে এছাড়াও আরও অনেক আবিষ্কার আছে যা কিনা কোন অংশেই কম নয়। এরকম হাজারো আবিষ্কার আমাদের উপহার দিয়েছে বর্তমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর জীবনধারা। ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক কিছুই আবিষ্কৃত হবে। বিশ্ব এগিয়ে যাবে আরও সামনে, উন্নতির উচ্চশিখরে।

৯। কম্পিউটার

বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হল কম্পিউটার। বলতে গেলে বর্তমান বিশ্ব চলছে এই কম্পিউটারের উপর ভর করেই। আসলে মানব সভ্যতায় কম্পিউটারের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। যে কাজ গুলো আগে মানুষের করতে মাথার ঘাম ছুটে যেত সেসব কাজ আজ মুহূর্তেই আমরা করে ফেলছি কম্পিউটারের বদলোতে। আবার এমন কিছু কাজ কম্পিউটারের সহায়তায় আমরা করতে পারছি, কম্পিউটার ছাড়া সেসব কাজ কল্পনা করাও কঠিন।

মূলত চার্লস ব্যাবেজ কে আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয়। তবে কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরে পুরানো। এই আবিষ্কারের সূত্রপাত হয় অ্যাবাকাস নামে এক ধরনের গণনা যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায় ব্যবহৃত হত এই অ্যাবাকাস নামক গণনা যন্ত্রটি। এরপর উল্লেখযোগ্য গণনা যন্ত্র ছিল জন নেপিয়ারের আবিষ্কৃত নেপিয়ারের বোন যন্ত্রটি। এই যন্ত্রে ব্যবহৃত হত নয়টি ভিন্ন ভিন্ন বোন বা হার যা দিয়ে গুন বা ভাগ করা যেত। এই যন্ত্রেই সর্বপ্রথম দশমিক সংখ্যা-পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

এরপর অবশ্য সপ্তদশ শতক পর্যন্ত গণনা যন্ত্রের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বিকাশ হয় নি। তবে এই খরা কাটে ব্রেইজ প্যাসকেল এর হাত ধরে। ব্রেইজ প্যাসকেল সর্বপ্রথম পৃথিবীর প্রথম সার্থক ক্যালকুলেটিং মেশিন আবিষ্কার করেন, বর্তমানে যা আমরা ক্যালকুলেটর নামে চিনি। তার এই ক্যালকুলেটর দিয়ে যোগ- বিয়োগ করা গেলেও গুন ও ভাগ করা যেত না। পরবর্তীতে প্যাসকেল বিভিন্ন সময় এই যন্ত্রের উন্নতি সাধন করেছিলেন।

প্যাসকেলের পরেই কম্পিউটার বা গণক যন্ত্রের ইতিহাসে যোগ হয় আরেক জন গণিতবিদের নাম, বিখ্যাত জার্মান ভিলহেলম লিবনিজ। লিবনিজের গণক যন্ত্র যোগ বিয়োগ তো করতে পারতই সেই সাথে গুণ ভাগ এমনকি সংখ্যার বর্গমূল পর্যন্ত বের করতে পারত। এরপর ১৮৩৬ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজ তৈরি করেন উন্নত মানের এক গণনা যন্ত্র যার নাম ছিল এনালাইটিক ইঞ্জিন। এটি ছিল এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় গণনা যন্ত্র। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এটি তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে পারত।

১৯৪৪ সালে বিশ্বে সর্ব প্রথম স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারটি তৈরি করেন অধ্যাপক হাওয়ার্ড আইকেন এবং আইবিএম এর প্রকৌশলীরা। কম্পিউটারটি তৈরি করা হয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটি পরিচিত ছিল মার্ক-1 নামে। এটি অনেক বড় বড় গাণিতিক হিসাবে পারদর্শী ছিল। এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে কম্পিউটারের উন্নতি সাধন। আর এই যন্ত্রটি কি করতে পারে তা আজ আমরা স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি।

১০। ইন্টারনেট

বর্তমান যুগ তথ্য ও প্রযুক্তির যুগ। আর এটি শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এমনকি কম্পিউটার জগতে বিপ্লব এনে দিয়েছে ইন্টারনেট। আমরা এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি যে ইন্টারনেট ছাড়া আমরা একটি দিন ও কল্পনা করতে পারি না। হাজার হাজার সুযোগ সুবিধা দেওয়া এই ইন্টারনেট সত্যিই বিজ্ঞানের এক বিরাট চমক।

ইন্টারনেট বিশ্বব্যাপী তথ্য আদান প্রদান ও প্রচারের জন্য একটি অভূতপূর্ব মাধ্যম। এটি এমন একটি মাধ্যম যা কিনা অতিক্রম করে ফেলেছে যে কোন ভৌগলিক সীমানা।

মূলত ১৯৬০ এর গোঁড়ার দিকে ইন্টারনেটের আগমন ঘটে। এম-আইটির জে.সি.আর. লিক্লাইডার “ইন্টারগ্যাল্যাক্টিক নেটওয়ার্ক” নামক একটি ধারণার জন্ম দেন। এই পদ্ধতিতে সকল কম্পিউটার কে একটি নেটওয়ার্ক এর আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। এরপর ১৯৬০ এর শেষের দিকে ARPANET বা Advanced Research Projects Agency Network এর আগমন ঘটে। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের অর্থায়নে তৈরি একটি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা যা কয়েকটি কম্পিউটারকে একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসত।

১৯৮৩ এর পর থেকে বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে আধুনিক ইন্টারনেট আবিষ্কারের দিকে এগুতে থাকে এবং এই প্রক্রিয়া এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি করে বিখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী টিম বার্নাস লি’র World Wide Web বা WWW আবিষ্কারের মাধ্যমে। তার আবিষ্কার আজকের হাইপার-লিংক বা ওয়েবসাইট ভিত্তিক ইন্টারনেটের সূত্রপাত ঘটায়।

১১। ওয়াটার হুইল

ইতিহাসবিদ হেলাইন সেলিনের মতে, পারস্য সাম্রাজ্য (বর্তমান ইরাক, ইরান) এ ৩৫০ খ্রিষ্ট পুর্বাব্দে ওয়াটার হুইলের প্রথম ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে এ আবিষ্কার ধীরে ধীরে পৃথিবীর  বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ যন্ত্রের কল্যাণেই কৃষিকাজে সেচ দেয়া থেকে শুরু করে শিল্পবিপ্লবের সূচনা ঘটে। যার ফলে মানবসভ্যতা এগিয়ে গেছে অনেক দ্রুততার সঙ্গে। আর তাই অনেকের মতে, মানবসভ্যতার অন্যতম সেরা আবিষ্কার এই ওয়াটার হুইল।

১২। ঘড়ি

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ অব্দে মিশরে নির্মিত সূর্যঘড়ি বা Sundial এর মাধ্যমেই যাত্রা শুরু হয় ঘড়ির ব্যবহারের। এরপর সময়ের বিবর্তনে মানবসভ্যতায় আবিষ্কৃত হয়েছে তারাঘড়ি, জলঘড়ি, আগুনঘড়ি, বালুঘড়ি সহ নানান রকমের ঘড়ি। খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ অব্দে গ্রিক পদার্থবিদ আর্কিমিডিস প্রথম ক্লক আবিষ্কার করেন। ক্লকের বিবর্তনের হাত ধরে এরপর পকেটে বহনযোগ্য ছোটঘড়ি ‘ওয়াচ’ তৈরি হয়। তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন রকমের আধুনিক ঘড়ি আবিষ্কৃত হতে থাকে। মানবসভ্যতায় যা কিনা সঠিক সময় নির্ণয় করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে আরও নানাবিধ কাজে। আর তাই ঘড়ি মানবসভ্যতার অন্যতম সেরা আবিষ্কার।

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button