মহাকাশ

যেভাবে পারসিভারেন্সের সংগৃহীত নমুনা মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে নাসা

নাসার পারসিভারেন্স রোভার সফলভাবে মঙ্গলে অবতরণ করেছে। এটি মঙ্গল থেকে যে সকল নমুনা সংগ্রহ করবে তা ২০৩১ সাল নাগাদ পৃথিবীতে নিয়ে আসবে নাসার পাঠানো আরেকটি মহাকাশযান।

মঙ্গল থেকে নমুনা সংগ্রহ ও পৃথিবীতে নিয়ে আসার এই পরিকল্পনায় আগামি ১০ বছরে মোট ৩টি মিশন কাজ হবে। এই মিশনের নাম দিয়েছে নাসা: মার্স স্যাম্পল রিটার্ন (MSR) মিশন। অভিযানের প্রকল্প বিজ্ঞানী কেন ফারলে বলেন, “মঙ্গল থেকে নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারে কয়েক দশক ধরে কাজ চলছে। আমরা এখন এমন অবস্থায় যে সবকিছু যদি পরিকল্পনা মাফিক ঘটে তাহলে ২০৩১ সাল নাগাদ মঙ্গল থেকে নমুনা পৃথিবীতে এসে পৌঁছবে।”

পারসিভারেন্স অনেক ভাবেই এর আগের রোভারগুলির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এর আগেরগুলি হলো অপরচুনিটি (২০০৪), স্পিরিট (২০০৪), সোজোরনার (১৯৯৭) এবং কিউরিওসিটি (২০১২)। তবে পারসিভারেন্স এদের প্রত্যেকের চাইতে বড় ও ভারি। বিজ্ঞানীরা পাথর ও মাটি সংগ্রহ করা এবং তা ফেরত নিয়ে আসার জন্য পারসিভারেন্সের ভেতরেই একটি নমুনা সংগ্রহকারী ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

নমুনাগুলি কোথা থেকে আসছে?

পারসিভারেন্স নেমেছে মঙ্গলের জেজেরো ক্রেটারের প্রান্তে। মঙ্গল গ্রহের এই এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের কারণ। কিন্তু আগে তারা মনে করতেন অবতরণের জন্য এই অঞ্চল ঝুঁকিপূর্ণ। কয়েকশো কোটি বছর আগে মঙ্গল গ্রহে যখন পানির অস্তিত্ব ছিল, তখন এই ক্রেটারেও বিশাল হ্রদ ছিল বলে ধারণা করা হয়।

নাসা’র প্ল্যানেটরি সায়েন্স ডিভিশনের পরিচালক লরি গ্লেজ গত মাসে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “বিজ্ঞানীরা এমন পাথরের সন্ধান করবেন যেটা পানিতে তৈরি হয়ে থাকতে পারে, এবং খুব সম্ভবত জীবনের রাসায়নিক বন্ধনের প্রমাণগুলিকে সংরক্ষণ করে রেখেছে।” জেজেরো’তে একটি নদীর অববাহিকার চিহ্ন অক্ষত অবস্থায় আছে। এরকম অববাহিকা তৈরি হয় যখন পানি অনেক পরিমাণে পলি জমা করে। পৃথিবীর নদী অববাহিকায় প্রাণের বিকাশ ঘটেছিল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন প্রাচীন মঙ্গলেও এমনটি ঘটে থাকতে পারে।

“জেজেরো এমন একটি জায়গা হতে পারে যা একসময় বাসযোগ্য ছিল,” ফারলি বলেন। “আমরা জীবন বলতে যা বুঝি তার উপস্থিতি হয়ত এই হ্রদে ছিল। এবং এই অববাহিকার কাদামাটি জীবনের অস্তিত্বের জৈবিক প্রমাণ সংরক্ষণের জন্য আসলেই উপযুক্ত।”

পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য মঙ্গলের নমুনা সংগ্রহ :

পারসিভারেন্স একটি ড্রিল বিট ব্যবহার করে নমুনাগুলি সংগ্রহ করবে। এই ড্রিল বিট প্রায় ২ বছর ধরে মঙ্গলপৃষ্ঠের ওপরে সিলিন্ডার আকৃতিতে কোর ড্রিল করবে। সংগৃহীত উপাদানগুলি গবেষকদেরকে পাথরের স্তর ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তথ্য দিবে। রোভারটি মাটি থেকে প্রায় ৪০টি কোর পুনরুদ্ধার করবে। প্রতিটি কোরের ওজন প্রায় আধা আউন্স, বা এক খণ্ড চকের সমান। প্রাথমিক অবস্থায় সংরক্ষণ করার জন্য কোরগুলিকে নমুনা টিউবে রেখে ট্রিপল-সিল করে দেয়া হবে।

২০২৬ থেকে ২০২৮-এর মধ্যে, নাসা ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মঙ্গল গ্রহে একটি স্যাম্পল রিট্রিভাল ল্যান্ডার, অর্থাৎ নমুনা সংগ্রহকারী যান উৎক্ষেপণ করবে। ‘মার্স অ্যাসেন্ট ভেহিকল’ নামের যানটি রোভার ও রকেট উভয়ই বহন করবে। ২০২৮ সালে জেজেরোতে অবতরণের পর ‘মার্শিয়ান ডিউন বাগি’ পারসিভারেন্সের রেখে দেওয়া কোরগুলি পুনরুদ্ধার করে রকেটের ভেতর লোড করবে। একবার সিল করা হয়ে গেলে রকেটটিকে উৎক্ষেপণ করা হবে।

রকেটটি মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠ থেকে যাত্রা শুরু করে বাস্কেটবল আকৃতির একটি কন্টেইনারকে মঙ্গলকে ঘিরে রাখা কক্ষপথে নিক্ষেপ করবে। এই কন্টেইনারের মধ্যে নমুনা সংরক্ষিত থাকবে। জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির প্ল্যানেটরি সায়েন্সের পরিচালক ববি ব্রাউন একটি সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “এটা অনেকটা রিলে রেসের ব্যাটনের মত। এই কনটেইনারটি নমুনা নিয়ে আসার কেন্দ্রস্থল।”

পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্য, আরেকটি মহাকাশযান মঙ্গলের কক্ষপথের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। ‘আর্থ রিটার্ন অরবিটার’, আকারে প্লেনের মতো বিশাল। গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ করতে থাকা নমুনার ক্যাশটি সংগ্রহ করবে। আশা করা যাচ্ছে, ২০৩১ সালেই এই নমুনা পৃথিবীতে ফিরে আসবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকল্পের বিকাশ থেকে শুরু করে নমুনা পুনরুদ্ধারের প্রায় দুই দশকের সময়রেখাটি যৌক্তিক।

ফারলে বলেন, “একবারে পুরো কাজ করাটা অনেক জটিল হবে। তাই কয়েক বছর ধরে করাই ভালো। এতে এক বছরে যে টাকা ব্যয় হবে তার পরিমাণও অতিরিক্ত মনে হবে না। এছাড়া, এই অভিযানের প্রতিটি অংশের উদ্ভাবন ও তৈরির জন্য প্রতিভা প্রয়োজন। এগুলি দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রস্তুত করার কারণে আমরা যথেষ্ট প্রকৌশলী পাবো।

ভিনগ্রহে অতীত জীবনের লক্ষণের অনুসন্ধান :

কোটি কোটি বছর আগের জীবনের লক্ষণ অনুসন্ধান করতে গেলে বিজ্ঞানীদের অবশ্যই বিশাল ও সংবেদনশীল যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। মঙ্গলের রোভারের মাধ্যমে কাজটা না করতে পারা তার অন্যতম কারণ। এই কাজে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলি আরো জটিল।

ফারলে বলেন, “পরীক্ষার জন্য আমরা যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করব সেগুলির মধ্যে কোনো কোনোটি আকারে গাড়ির সমান বড়। আপনি চাইলেই এমন যন্ত্রকে ওড়াতে পারবেন না।”

সংগৃহীত নমুনা মঙ্গল গ্রহের ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণা দেবে। গ্লেজ বলেন, “পৃথিবীতে আমাদের কাছে মঙ্গলের উল্কা আছে। কিন্তু মঙ্গল গ্রহের শিলা ও মাটির নমুনার চেয়ে এটা আলাদা। এছাড়া আমরা জানি এই শিলা ও মাটি আমরা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছি। মঙ্গলগ্রহের নমুনা পৃথিবী ও সৌরজগতের অন্য কোথাও জীবনের উৎস, বিবর্তন সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।”

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button