মঙ্গলগ্রহে হেলিকপ্টার ওড়াবে মানুষ!

স্বপ্ন সত্যি হয়েছে! ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২ঃ৫৫ মিনিটে (শুক্রবার) শ্বাসরুদ্ধকর ৭ মিনিটের দুশ্চিন্তা কাটিয়ে মঙ্গলগ্রহে অবতরণ করেছে নাসার মহাকাশযান পারসিভ্যারেন্স। তার পেটের মধ্যেই থাকছে বক্স আকৃতির একটি অনুসন্ধানী হেলিকপ্টার বা ক্ষুদ্রাকৃতির ড্রোন, যার নাম ‘ইনজেনুয়িটি’ (অর্থ- অকপট, উধভাবনীক্ষমতাসম্পন্ন, চতুর ইত্যাদি গুণসম্পন্ন)। অবতরণের পরপরই এটি মঙ্গলের আকাশে নিজে থেকেই উড়বে এবং ছবি তুলে ও বস্তু সংগ্রহ করে তা পৃথিবীতে পাঠাবে। সায়েন্স ফিকশনের মতো শোনালেও এই অসাধ্য সাধন করতে চলেছে আজ মানুষ! তাই নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এটা একটা বড় মাইলফলক।
তবে লালগ্রহটিতে হেলিকপ্টার ওড়ানোর কাজটা মোটেও সহজে হচ্ছে না। ক্ষুদ্র ‘ইনজেনুয়িটি’কে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে এই প্রচেষ্টায় সফলতা পেতে হলে; যার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো–পৃথিবীর চেয়েও অনেক পাতলা ঘনত্বের বায়ুমন্ডলে পাখা ঘুরিয়ে উড়তে পারার চ্যালেঞ্জ! মঙ্গলের আবহাওয়া পৃথিবীর চেয়ে অনেকটাই আলাদা– মঙ্গলের বায়ুস্তরের ঘনত্ব পৃথিবীর মাত্র ১ শতাংশ! কাজেই, মঙ্গলের আকাশে হেলিকপ্টার ওড়াতে হলে খুবই পাতলা বায়ুস্তরের ভেতর দিয়ে তা ওড়াতে হবে। চিন্তা নেই, এমনভাবেই তাকে তৈরী করা হয়েছে। হিসাবনিকাশ ঠিক থাকলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ মানুষকে নিরাশ করবে না।
‘ইনজেনুয়িটি’ নামের এই উড়তে সক্ষম বস্তুটিকে ‘হেলিকপ্টার; বলা হলেও এটি আসলে ক্ষুদ্রাকায় ড্রোনের মতই, আমরা সচরাচর সাম্প্রতিক সময়ে যেগুলো দেখতে অভ্যস্ত। হেলিকপ্টারটির চারটি পা আছে, আছে একটি বক্সাকৃতির দেহ। এর আছে কার্বন ফাইবারে তৈরি ডানা/পাখা/ব্লেড, যেগুলো দুটি বিপরীত দিকে ঘূর্ণায়মান রটরে আলাদাভাবে সাজানো। হেলিকপ্টারটি পৃথিবী থেকে অনেক দূরে থাকায় এতো দূর থেকে কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। এটি নিজের শরীরে থাকা কম্পিউটারে প্রকৌশলীদের পদত্ত প্রোগ্রাম অনুযায়ী নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে মঙ্গলের আকাশে উড়ে উড়ে তথ্য, বস্তু ও ছবি সংগ্রহ করবে। আকৃতিতে ক্ষুদ্র হলেও এতে থাকছে ছবি তোলার জন্য দুটি উন্নতমানের ক্যামেরা, নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কতগুলো কম্পিউটার এবং দিকনির্দেশক সেন্সর। নিজের ব্যাটারিগুলোকে রিচার্জ করার জন্য এতে কতগুলো সৌরকোষও (সোলার সেলস) থাকছে। এই সৌরকোষগুলোর মাধ্যমে আহরিত শক্তির অনেকটাই খরচ হয়ে যাবে তার নিজেকে উষ্ণ রাখতেই, কেননা রাতে মঙ্গলের তাপমাত্রা মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত নেমে যেতে পারে।
এবার আসি মঙ্গলের আকাশে উড়ে বেড়ানোর বিষয়টার আলোচনায়। ইনজেনুয়িটি হেলিকপ্টারের ওজন মাত্র ৪ পাউন্ড বা ১ দশমিক ৮ কেজি। এর পাখাগুলো দেহের তুলনায় অনেক বড় আকৃতির, যা ৫ গুণ দ্রুত ঘুরবে অর্থাৎ প্রতি মিনিটে ২ হাজার ৪০০ বার ঘুরবে। তবেই এটি পৃথিবীতে যেটুকু উচ্চতায় উড়তো সেই সমান উচ্চতায় মঙ্গলগ্রহে উড়তে সক্ষম হবে। কারণটা তো আগেই বলেছি– মঙ্গলের বায়ুস্তর পৃথিবীর চেয়ে অনেক পাতলা বিধায় মঙ্গলের আকাশে উড়তে তাকে কম ওজনবিশিষ্ট এবং প্রতি মিনিটে অধিক পরিমাণে ঘূর্ণনে সক্ষম হতে হবে। তবে মঙ্গলের অভিকর্ষ বল (যে বলে কোনো বস্তুকে পৃথিবী বা মঙ্গল তার কেন্দ্রের দিকে টানে) পৃথিবীর ৩ ভাগের ১ ভাগ, তাই মঙ্গলে উড়ে বেড়ানোর ক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি সুবিধাও সে পাবে পৃথিবীর তুলনায়।
কতবার উড়বে ড্রোনটি? আপাতত, কিছুটা বিরতি দিয়ে প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই বিভিন্ন কাঠিন্যের অভিকর্ষ এলাকায় পাঁচটির মতো ফ্লাইট পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে ড্রোনটির। উড্ডয়নের স্থান হতে এটি ১০ থেকে ১৫ ফুট বা ৩ থেকে ৫ মিটার উচ্চতায় উড়বে এবং ১৬০ ফুট বা ৫০ মিটার পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করবে। এর প্রতিটি ফ্লাইট ৯০ মিনিট স্থায়ী হবে, যেখানে আমরা স্মরণ করতেই পারি ১৯০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনাতে রাইট ভাইদের সেই ঐতিহাসিক ফ্লাইট বা উড্ডয়নের স্থায়ীত্ব ছিলো ১২ সেকেন্ড।
কিন্তু, এই যে পৃথিবী থেকে এতো দূরে এতো খরচা করে নাসা একটি হেলিকপ্টার পাঠাচ্ছে, এর লক্ষ্যটা কি? ইনজেনুইয়িটির এই মঙ্গলাভিযানকে নাসা ব্যাখ্যা করছে ‘প্রযুক্তির প্রদর্শন’ হিসেবে– এমন এক প্রজেক্ট যা পারসিভ্যারেন্সের এ্যাস্ট্রোবায়োলজি মিশনের সঙ্গে নতুন একটি পারঙ্গমতা বা সামর্থকে যাচাই করে দেখতে চায়। যাহোক, এই মিশন যদি সফল হয়, তবে এটি “মূলত মঙ্গলকে আবিষ্কারের পরিপূর্ণ নতুন এক মাত্রা উন্মুক্ত করবে”– এমনটাই বলছেন ইনজেনুয়িটি হেলিকপ্টারের মুখ্য প্রকৌশলী বব বলরাম। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে আমাদের উপমহাদেশেরই আমাদের পাশের রাষ্ট্র ভারতের আইআইটি মাদ্রাজ এর সাবেক ছাত্র তিনি। বলতে ইচ্ছা হয়, “একদিন আমরাও…”!
ইঞ্জেনুয়িটির আগামী মডেলগুলো আরও উন্নত হবে, আরও ধীরে মঙ্গলে বিচরণ করে আরও ভালোভাবে একে খুঁটিয়ে দেখতে পারবে; হয়তো এমনকি রোবট বা মানুষ বহনেও তারা সক্ষম হবে। হয়তো পরবর্তী ধাপে তারা পারসিভ্যারেন্সের সঙ্গী হয়ে মঙ্গলের মাটি থেকে হালকা বস্তুসমূহ যেমন পাথর বা মাটির নমুনা ইত্যাদি সংগ্রহ করতে পারবে।
এতোটাই দূষণে মেতেছি আমরা এই জগতে, বলা তো যায় না কবে এই পৃথিবী মানুষের বসবাসের উপযুক্ততা হারায় আর আমাদের মঙ্গলের মতো বিকল্প আবাস খোঁজা বাধ্যতামূলক করে দেয়।
সবশেষে মনুষ্যজাতির পক্ষে চাঁদের পর মঙ্গলেও অভিযান পরিচালনার জন্য নাসাকে ধন্যবাদ।