মহাকাশ

চাঁদের দৃশ্যমান অংশে প্রথমবারের মত পানির অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে!!

নাসার Stratospheric Observatory for Infrared Astronomy (SOFIA) নিশ্চিত করেছে এই প্রথমবারের মত চাঁদের সূর্যালোক অংশে পানির অস্তিত্বের সন্ধান পেয়েছে তারা। পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত অন্যতম একটি বড় গর্ত ক্লাভিয়াস ক্রেটারে পানির অনু (H2O) শনাক্ত করেছে সোফিয়া। Nature Astronomy জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রে ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে নাসা। চন্দ্রপৃষ্ঠের পূর্ববর্তী অবজারভেশনগুলোতে চাঁদের পৃষ্ঠে হাইড্রোজেন শনাক্ত করা গেলেও পানি বা হাইড্রোক্সিল আয়ন আলাদাভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। চাঁদের এই অবস্থান থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় এই পানির ঘনত্ব ১০০ থেকে ৪১২ ppm যা ১২ আউঞ্চ পানির বোতলের সমান। । পল হার্টয বলেন “এই আবিষ্কার আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে চাঁদের পৃষ্ঠ সম্পর্কে আমাদের জানার ক্ষেত্র এবং গভীর মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য প্রাসঙ্গিক সংস্থান সম্পর্কে আকর্ষণীয় সব প্রশ্ন উত্থাপন করে। চাঁদের পৃষ্ঠে পাওয়া এই জলের পরিমানের যদি তুলনা করতে যাই তাহলে ওখানে যে পরিমান জল আছে তার ১০০ গুন জল আছে আমাদের পৃথিবীর সাহারা মরুভূমিতে। যদিও এ পানির পরিমাণ অনেক কম তবুও সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন থেকে যায় তা হলো কীভাবে চাঁদে পানির উৎপত্তি হল আর কিভাবেই সেই পানি চাঁদের এই বায়ুহীন শুষ্ক পরিবেশে টিকে আছে!!

গভির মহাকাশে পানি অতি মূল্যবান একটি উৎস এবং প্রাণের অস্তিত্বের অন্যতম চিহ্ন। ১৯৬৯ সালে এপোলো ১১ এর মহাকাশচারীরা যখন মিশন শেষে পৃথিবীতে ফিরে আসে তখন ধারনা করা হয়েছিল চাঁদের পৃষ্ঠ পুরপুরি শুষ্ক। শুধু তাই নয় বিগত ২০ বছর ধরে চাঁদে চালানো কাক্ষিয় বা পৃষ্ঠীয় সকল পর্যবেক্ষণ যেমন Lunar Crater Observation and Sensing Satellite, কিছু স্পেসক্রাফট যেমন Cassini Mission, Deep Impact Comet Mission, ISRO’s Chandrayaan-1 Mission, NASA’s ground-based Infrared Telescope Facility সবাই চন্দ্রপৃষ্ঠে বিস্তিতভাবে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ চালিয়ে সূর্যালোক দিয়ে আলকিত স্থানগুলোতে হাইড্রেশানের চিত্র লক্ষ্য করেন। আর এজন্যই এতদিন আমরা বিভিন্ন জায়গায় শুনে বা জেনে এসেছি যে চাঁদের পৃষ্ঠে পানির অস্তিত্ব আছে। কিন্তু বিগত বছরের মিশনগুলতে আলাদা আলাদা ভাবে পানি বা হাইড্রোক্সিল (OH) আয়ন শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি যা পানির অস্তিত্বের একটি সীমাবদ্ধতা বলা যেতে পারে। তবে এবার এই ২০২০ সালে এসে উন্নত সব প্রযুক্তি দিয়ে প্রথমবারের মত সরাসরি পানির অস্তিত্বের দেখা মিলেছে। এই গবেষণাপত্রের প্রধান গবেষক কাসেই হন্নিবাল বলেছেন “সোফিয়া’র পর্যবেক্ষণের আগে আমরা জানতাম কয়েক ধরনের হাইড্রেশান রয়েছে, কিন্তু আমরা জানতাম না যে ঠিক কতটুকু এবং সত্যিই যদি পানির অনু থেকে থাকে তাহলে তা কেমন? আমরা যে পানি পান করি সেরকম নাকি নর্দমা বা ড্রেনের পানির মত!” সোফিয়া চাঁদ পর্যবেক্ষণের একটি নতুন উপায় প্রস্তাব করেছিল যেটার মাধ্যমেই এই আবিষ্কার সক্ষম হয়েছে। সোফিয়া একটি বোয়িং ৭৪৭এসপি বিমান যেখানে রয়েছে একটি ১০৬ ইঞ্চি ব্যাসের একটি টেলিস্কোপ যার শক্তিক্ষমতা এতই বেশি যে তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ৯৯% জলীয়বাষ্প শনাক্ত করতে পারে। সোফিয়া চাঁদের পৃষ্ঠের ৪৫০০০ ফুট উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় Faint Object infrared CAmera for the SOFIA Telescope (FORCAST) ব্যবহার করে পানির অনুর সমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতে (৬.১ মাইক্রন) পর্যবেক্ষণ করে সূর্যালোক পড়া ক্লাভিয়াস ক্রেটারে ঘন কিছু দেখতে পায়। হন্নিবাল বলেন “সামান্য বায়ুমণ্ডলেরও অনুপুস্থিতে, পানি সূর্যের আলোয় আকাশে হারিয়ে যাবে। কিন্তু তবুও আমরা দেখছি কোনভাবে কোনকিছু সেখানে পানি উৎপন্ন করছে এবং কোনকিছু সেই পানিকে সেখানে আটকে রাখছে।“

এই পানির উৎপত্তির কারণ হিসেবে আপাতত দুইটি সম্ভবনাকে দায়ি করা হয়েছে। প্রথমটি চাঁদের মাটিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উল্কাবৃষ্টি হওয়ার ফলে তা সামান্য পরিমাণে জল বয়ে আনতে পারে। দ্বিতীয়টি সৌরঝড়। সৌরঝড়ের ফলে সূর্য থেকে সৌরবাতাস হাইড্রোজেন বয়ে আনে এবং চাঁদের অক্সিজেন সমৃদ্ধ মাটির সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রক্সিল আয়ন তৈরি করে, তাছাড়াও ক্ষুদ্র উল্কাগুলোও সেই হাইড্রক্সিল আয়ন কে পানিতে পরিণত করতে পারে। পানি তৈরি হওয়ার পরে যে প্রশ্নটি আসে তা হলো সূর্যের তাপের ফলে এই বায়ুহীন পরিবেশে সেই পানিগুলো কীভাবে জলীয়বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করছে? এর কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে সেই ক্ষুদ্র উল্কাগুলকে। তারা প্রচণ্ড উত্তাপের সাথে চাঁদের মাটি স্পর্শ করার ফলে সেখানে যে গর্ত হয় তাতেই জল আটকে থাকতে পারে। আর আরেকটি সম্ভবনা হলো চাঁদের মাটির কোনো অংশের মধ্যে এই পানি লুকিয়ে থাকতে পারে ফলে একইসাথে তা সূর্যালোক থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

চাঁদে পানির অস্তিত্বের এই সরাসরি প্রমাণ চাঁদ নিয়ে আমাদের আগ্রহের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে। যুগে যুগে হাজারও রূপকথার মহানায়কের কল্পনার ইন্দ্রজাল এবং মানবসভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে পৃথিবীর আকাশে দেখে আসা এই সবচেয়ে সুন্দর বস্তু সম্পর্কে আমাদের জানা আরও একধাপ এগিয়ে গেলো!!

তথ্যসূত্রঃ https://www.nature.com/articles/s41550-020-01222-x#_blank
https://www.nasa.gov/press-release/nasa-s-sofia-discovers-water-on-sunlit-surface-of-moon/

Facebook Comments

Related Articles

Back to top button