উইন্ড টারবাইন দিয়ে যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে ‘উইন্ড টারবাইন’ সাধারণ একটি নীতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। আর তা হলো, এটি সিলিং ফ্যানের মতো বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বাতাস তৈরি করার বদলে বাতাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
প্রাথমিক ভাবে উইন্ড টারবাইনের সাথে যুক্ত প্রপেলারের মতো ব্লেডে বাতাস লাগলে সেটা ঘোরে। ঘূর্ণায়মান এই ব্লেডের সঙ্গে রোটর নামের একটি যন্ত্রাংশ যুক্ত থাকে। সেই রোটরের সাহায্যে আবার একটি জেনারেটর সচল থাকে। আর এই জেনারেটরের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
বায়ুশক্তি হলো মূলত এক ধরনের সৌরশক্তি, যা একইসঙ্গে চলমান তিনটি প্রাকৃতিক ঘটনার ফলে সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক এই ৩টি ঘটনা হলো:
• সূর্যের তাপে অসমভাবে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হওয়া
• পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের ওপরে একেক অংশের গঠন একেক ধরনের হওয়া
• নিজ অক্ষে পৃথিবীর ঘূর্ণন
পৃথিবীর একেক অংশে বায়ু প্রবাহের ধরন এবং গতি একেক রকম হয়ে থাকে। কারণ ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকম। এছাড়াও একই অঞ্চলে থাকা পানি, উদ্ভিদ বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কারণে সেই অঞ্চলের বায়ু প্রবাহের ধরন এবং গতিতে পরিবর্তন আসে। ঘুড়ি ওড়ানো থেকে শুরু করে নৌযান চালানো বা বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মতো নানান উদ্দেশ্যে মানুষ এই বায়ু প্রবাহ বা গতি শক্তি ব্যবহার করে।
যান্ত্রিক শক্তি বা বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য যে পদ্ধতিতে বাতাস ব্যবহৃত হয়, সেটা ব্যাখ্যা করতে প্রধানত দুটি পরিভাষা প্রচলিত রয়েছে। সেগুলি হলো, “বায়ু শক্তি” এবং “বায়ু ক্ষমতা”। বাতাস ব্যবহার করে উৎপন্ন এই যান্ত্রিক শক্তি শস্য মাড়াই বা পানি পাম্প করার মতো সরাসরি কোনো কাজের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। অথবা কোনো জেনারেটরের মাধ্যমে এই যান্ত্রিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করা যেতে পারে।
উইন্ড টারবাইনে থাকা রোটর ব্লেডের মাধ্যমে বায়ুচালিত বল বা ফোর্স ব্যবহার করে বায়ু শক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করা হয়। যা বিমানের পাখা বা হেলিকপ্টার রোটর ব্লেডের মতোই কাজ করে। ব্লেডে যখন বায়ু প্রবাহিত হয়, তখন এর একপাশে বাতাসের চাপ কমে যায়। ব্লেডের দুই পাশজুড়ে বায়ুচাপের পার্থক্যের ফলে উর্ধ্বে উত্তোলন এবং নিম্নে টান, এই দুই ধরনের বল বা ফোর্সের সৃষ্টি হয়। তবে উত্তোলনের বল টানের চেয়ে শক্তিশালী এবং এর প্রভাবেই রোটরটি ঘোরে।
জেনারেটরের সাথে রোটরটি দুইভাবে যুক্ত থাকতে পারে। রোটর হয়তো গিয়ারবক্সের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু শ্যাফট এবং গিয়ারের সাহায্যে যুক্ত থাকবে অথবা সরাসরি জেনারেটরের সাথে যুক্ত থাকবে। উইন্ড টারবাইনের সঙ্গে সাধারণত ছোট আকারের জেনারেটর যুক্ত থাকে। এভাবে বায়ুচালিত বলের মাধ্যমে জেনারেটরের নির্দিষ্ট অংশ ঘুরলেই সৃষ্টি হয় বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে প্রধানত দুই ধরনের উইন্ড টারবাইন ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ক. আনুভূমিক অক্ষের টারবাইন
উইন্ড টারবাইনের কথা শুনলে বেশিরভাগ মানুষের মনে প্রথমেই আনুভূমিক অক্ষের টারবাইনের ছবি ভেসে ওঠে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব টারবাইনে তিনটি ব্লেড থাকে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে বাতাসের বিপরীতে বসানো হয়। এ ধরনের টারবাইন সাধারণত টাওয়ার বা উঁচু স্থাপনার শীর্ষে এমনভাবে বসানো থাকে, যাতে ব্লেডগুলি বাতাসের দিকে ফিরে থাকে।
খ. উল্লম্ব অক্ষের টারবাইন
উল্লম্ব অক্ষের টারবাইনে মূল রোটর শ্যাফটটি বাতাসের সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবে সেট করা হয়। আর এর মূল উপাদানগুলি থাকে টারবাইনের গোড়ায়। তবে এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে এ ধরনের টারবাইনে অন্যান্য সব পদ্ধতি একইরকম থাকে।
বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে কীভাবে এবং কোথায় সংযোগ স্থাপন করা হয়, তার ভিত্তিতে আধুনিক উইন্ড টারবাইনগুলি আরো কিছু শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
১. ভূমি-ভিত্তিক উইন্ড টারবাইন
ভূমি ভিত্তিক উইন্ড টারবাইনগুলি ১০০ কিলোওয়াট থেকে শুরু করে কয়েক মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।
বড় আকারের উইন্ড টারবাইন তৈরি করলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেকটাই কমানো সম্ভব হয়। এভাবে বেশ কয়েকটি টারবাইন মিলিয়ে একটি উইন্ড প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়, যা থেকে একসঙ্গে অনেক বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করা যায়।
২. সমুদ্র উপকুলীয় উইন্ড টারবাইন
এ ধরনের উইন্ড টারবাইনগুলি সাধারণত আকারে বিশাল হয়। অনেক সময় এ ধরনের টারবাইনের আকার স্ট্যাচু অফ লিবার্টি থেকেও বড় হয়ে থাকে।
ভূমি ভিত্তিক টারবাইন স্থাপনে পরিবহনের যে সমস্যা থাকে, এসব টারবাইনের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা হয় না। কেননা সমুদ্রে জাহাজে করে অনেক বড় বড় যন্ত্রাংশ সহজেই পরিবহন করা যায়।
এই টারবাইনগুলি সমুদ্রের ওপর দিয়ে আসা শক্তিশালী বায়ু প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করতে পারে।
৩. ছোট আকারের উইন্ড টারবাইন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের টারবাইন সাধারণত আকারে ছোট হয়। এসব উইন্ড টারবাইন গ্রাহক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্যে স্থাপন করা হয়, অথবা এমন জায়গায় স্থাপন করা হয় যেখানে উৎপন্ন বিদ্যুৎ শক্তি সরাসরি গ্রাহকদের জন্যেই ব্যবহৃত হবে।
আবাসিক, কৃষি এবং ছোট বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকায় সাধারণত ১০০ কিলোওয়াটের কম বিদ্যুৎ উৎপাদনে ছোট আকারের এসব উইন্ড টারবাইন ব্যবহৃত হয়। ছোট আকারের এসব টারবাইন সাধারণত ডিজেল জেনারেটর বা ব্যাটারি দ্বারা চালিত মাইক্রোগ্রিডের সাথে যুক্ত থাকে।